Sunday, October 18, 2015

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ -- জীবনানন্দ দাশ

 

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ

- জীবনানন্দ দাশ

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই - প্রীতি নেই - করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব'লে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।


 সূর্যতামসী

- জীবনানন্দ দাশ

 কোথাও পাখির শব্দ শুনি;
কোনো দিকে সমুদ্রের সুর;
কোথাও ভোরের বেলা র'য়ে গেছে - তবে।
অগণন মানুষের মৃত্যু হ'লে - অন্ধকারে জীবিত ও মৃতের হৃদয়
বিস্মিতের মতো চেয়ে আছে;
এ কোন সিন্ধুর সুর:
মরণের - জীবনের?
এ কি ভোর?
অনন্ত রাত্রির মতো মনে হয় তবু।
একটি রাত্রির ব্যথা সয়ে -
সময় কি অবশেষে এ-রকম ভোরবেলা হয়ে
আগামী রাতের কালপুরুষের শস্য বুকে ক'রে জেগে ওঠে?
কোথাও ডানার শব্দ শুনি;
কোন দিকে সমুদ্রের সুর -
দক্ষিণের দিকে,
উত্তরের দিকে,
পশ্চিমের পানে?

সৃজনের ভয়াবহ মানে;
তবু জীবনের বসন্তের মতন কল্যাণে
সূর্যালোকিত সব সিন্ধু-পাখিদের শব্দ শুনি;
ভোরের বদলে তবু সেইখানে রাত্রি করোজ্জ্বল
ভিয়েনা, টোকিও, রোম, মিউনিখ - তুমি?
সার্থবাহ, সার্থবাহ, ওইদিকে নীল
সমুদ্রের পরিবর্তে আটলাণ্টিক চার্টার নিখিল মরুভূমি!
বিলীন হয় না মায়ামৃগ - নিত্য দিকদর্শিন;
যা জেনেছে - যা শেখেনি -
সেই মহাশ্মশানের গর্ভাঙ্কে ধূপের মত জ্ব'লে
জাগে না কি হে জীবন - হে সাগর -
শকুন্ত-ক্রান্তির কলরোলে।

 শীতরাত

 - জীবনানন্দ দাশ


এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে;
বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা,
কিংবা প্যাঁচার গান; সেও শিশিরের মতো, হলুদ পাতার মতো।

শহর ও গ্রামের দূর মোহনায় সিংহের হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে -
সার্কাসের ব্যথিত সিংহের।

এদিকে কোকিল ডাকছে - পউষের মধ্য রাতে;
কোনো-একদিন বসন্ত আসবে ব'লে?
কোনো-একদিন বসন্ত ছিলো, তারই পিপাসিত প্রচার?
তুমি স্থবির কোকিল নও? কত কোকিলকে স্থবির হ'য়ে যেতে দেখেছি,
তারা কিশোর নয়,
কিশোরী নয় আর;
কোকিলের গান ব্যবহৃত হ'য়ে গেছে।

সিংহ হুঙ্কার ক'রে উঠছে:
সার্কাসের ব্যথিত সিংহ,
স্থবির সিংহ এক - আফিমের সিংহ - অন্ধ - অন্ধকার।
চারদিককার আবছায়া-সমুদ্রের ভিতর জীবনকে স্মরণ করতে গিয়ে
মৃত মাছের পুচ্ছের শৈবালে, অন্ধকার জলে, কুয়াশার পঞ্জরে হারিয়ে যায় সব।

সিংহ অরন্যকে পাবে না আর
পাবে না আর
পাবে না আর
কোকিলের গান
বিবর্ণ এঞ্জিনের মত খ'শে খ'শে
চুম্বক পাহাড়ে নিস্তব্ধ।
হে পৃথিবী,
হে বিপাশামদির নাগপাশ, - তুমি
পাশ ফিরে শোও,
কোনোদিন কিছু খুঁজে পাবে না আর।

 মৃত্যু স্বপ্ন সংকল্প

 - জীবনানন্দ দাশ

 আমাদের জানা ছিলো কিছু;
কিছু ধ্যান ছিলো;
আমাদের উৎস-চোখে স্বপ্নছটা প্রতিভার মতো
হয়তো-বা এসে পড়েছিলো;
আমাদের আশা সাধ প্রেম ছিলো; - নক্ষত্রপথের
অন্তঃশূণ্যে অন্ধ হিম আছে জেনে নিয়ে
তবুও তো ব্রহ্মাণ্ডের অপরূপ অগ্নিশিল্প জাগে;
আমাদেরো গেছিলো জাগিয়ে
পৃথিবীতে;
আমরা জেগেছি - তবু জাগাতে পারিনি;
আলো ছিলো - প্রদীপের বেষ্টনী নেই;
কাজ ছিলো - শুরু হলো না তো;
তাহলে দিনের সিঁড়ি কি প্রয়োজনের?
নিঃস্বত্ব সূর্যকে নিয়ে কার তবে লাভ!
স্বচ্ছল শাণিত নদী, তীরে তার সারস-দম্পতি
ঐ জল ক্লান্তিহীন উৎসানল অনুভব ক'রে ভালোবাসে;
তাদের চোখের রং অনন্ত আকৃতি পায় নীলাভ আকাশে;
দিনের সূর্যের বর্ণে রাতের নক্ষত্র মিশে যায়;
তবু তারা প্রণয়কে সময়কে চিনেছে কি আজো?
প্রকৃতির সৌন্দর্যকে কে এসে চেনায়!

চারিদিকে প্রকৃতির

  - জীবনানন্দ দাশ

চারিদিকে প্রকৃতির ক্ষমতা নিজের মতো ছড়ায়ে রয়েছে।
সূর্য আর সূর্যের বনিতা তপতী—
মনে হয় ইহাদের প্রেম
মনে ক’রে নিতে গেলে, চুপে
তিমিরবিদারী রীতি হয়ে এরা আসে
আজ নয়—কোনো এক আগামী আকাশে।
অন্নের ঋণ,বিমলিন স্মৃতি সব
বন্দরবস্তির পথে কোনো এক দিন
নিমেষের রহস্যের মতো ভুলে গিয়ে
নদীর নারীর কথা—আরো প্রদীপ্তির কথা সব
সহসা চকিত হয়ে ভেবে নিতে গেলে বুঝি কেউ
হৃদয়কে ঘিরে রাখে, দিতে চায় একা আকাশের
আশেপাশে অহেতুক ভাঙা শাদা মেঘের মতন।
তবুও নারীর নাম ঢের দূরে আজ,
ঢের দূরে মেঘ;
সারাদিন নিলেমের কালিমার খারিজের কাজে মিশে থেকে
ছুটি নিতে ভালোবেসে ফেলে যদি মন
ছুটি দিতে চায় না বিবেক।
মাঝে মাঝে বাহিরের অন্তহীন প্রসারের
থেকে মানুষের চোখে-পড়া-না-পড়া সে কোনো স্বভাবের
সুর এসে মানবের প্রাণে
কোনো এক মানে পেতে চায়:
যে-পৃথিবী শুভ হতে গিয়ে হেরে গেছে সেই ব্যর্থতার মানে।
চারিদিকে কলকাতা টোকিয়ো দিল্লী মস্কৌ অতলান্তিকের কলরব,
সরবরাহের ভোর,
অনুপম ভোরাইয়ের গান;
অগণন মানুষের সময় ও রক্তের যোগান
ভাঙে গড়ে ঘর বাড়ি মরুভূমি চাঁদ
রক্ত হাড় বসার বন্দর জেটি ডক;
প্রীতি নেই—পেতে গেলে হৃদয়ের শান্তি স্বর্গের
প্রথম দুয়ারে এসে মুখরিত ক’রে তোলে মোহিনী নরক।
আমাদের এ পৃথিবী যতদূর উন্নত হয়েছে
ততদূর মানুষের বিবেক সফল।
সে চেতনা পিরামিডে পেপিরাসে-প্রিন্টিং-প্রেসে ব্যাপ্ত হয়ে
তবুও অধিক আধুনিকতর চরিত্রের বল।
শাদাসিদে মনে হয় সে সব ফসল:
পায়ের চলার পথে দিন আর রাত্রির মতন—
তবুও এদের গতি স্নিগ্ধ নিয়ন্ত্রিত ক’রে বার বার উত্তরসমাজ
ঈষৎ অনন্য সাধারণ।

 মহিলা

  - জীবনানন্দ দাশ

এইখানে শূন্যে অনুধাবনীয় পাহাড় উঠেছে
ভোরের ভিতর থেকে অন্য এক পৃথিবীর মতো;
‌এইখানে এসে প'ড়ে―থেমে গেলে― একটি নারীকে
কোথাও দেখেছি ব'লে স্বভাববশত

মনে হয়―কেননা এমন স্থান পাথরের ভারে কেটে তবু
প্রতিভাত হয়ে থাকে নিজের মতন লঘুভারে;
এইখানে সে দিনও সে হেঁটেছিল―আজও ঘুরে যায়;
এর ছেয়ে বেশি ব্যাখ্যা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন দিতে পারে;

অনিত্য নারীর রূপ বর্ণনায় যদিও সে কুটিল কলম
নিয়োজিত হয় নাই কোনোদিন―তবুও মহিলা
না ম'রে অমর যারা তাহাদের স্বর্গীয় কাপড়
কোঁচকায়ে পৃথিবীর মসৃণ গিলা

অন্তরঙ্গ ক'রে নিয়ে বানায়েছে নিজের শরীর ।
চুলের ভিতরে উঁচু পাহাড়ের কুসুম বাতাস ।
দিনগত পাপক্ষয় ভুলে গিয়ে হৃদয়ের দিন
ধারণ করেছে তার শরীরের ফাঁস ।

চিতাবাঘ জন্মাবার আগে এই পাহাড়ে সে ছিল;
অজগর সাপিনীর মরণের পরে ।
সহসা পাহাড় বলে মেঘখণ্ডকে
শূন্যের ভিতরে

‌ভুল হলে―প্রকৃতস্থ হয়ে যেতে হয়;
(চোখ চেয়ে ভালো করে তাকালেই হত;)
কেননা কেবলই যুক্তি ভালোবেসে আমি
প্রমাণের অভাববশত

তাহাকে দেখিনি তবু আজও;
এক আচ্ছন্নতা খুলে শতাব্দী নিজের মুখের নির্থলতা
দেখাবার আগে নেমে ডুবে যায় দ্বিতীয় ব্যথায়;
আদার ব্যাপারী হয়ে এইসব জাহাজের কথা

না ভেবে মানুষ কাজ করে যায় শুধু
ভয়াবহভাবে অনায়াসে
কখনো সম্রাট শনি শেয়াল ও ভাঁড়
সে নারীর রাং দেখে হো-হো ক̓রে হাসে ।

২.

মহিলা তবুও নেমে আসে মনে হয় ;
(বমারের কাজ সাঙ্গ হলে
নিজের এয়োরোড্রোমে―প্রান্তির মতো?)
আছেও জেনেও জনতার কোলাহলে

তাহার মনের ভাব ঠিক কী রকম―
আপনারা স্থির করে নিন;
মনে পড়ে, সেন রায় নওয়াজ কাপুর
আয়াঙ্গার আপ্তে পেরিন―

এমনি পদবী ছিল মেয়েটির কোনো একদিন;
আজ তবু উনিশশো বেয়াল্লিশ সাল;
সম্বর মৃগের বেড় জড়ায়েছে যখন পাহাড়ে
কখনো বিকেলবেলা বিরাট ময়াল,

অথবা যখন চিল শরতের ভোরে
নীলিমার আধপথে তুলে নিয়ে গেছে
রসুয়েকে ঠোনা দিয়ে অপরূপ চিতলের পেটি,―
সহসা তাকায়ে তারা উৎসারিত নারীকে দেখেছে;

এক পৃথিবীর মৃত্যু প্রায় হয়ে গেলে
অন্য-এক পৃথিবীর নাম
অনুভব ক'রে নিতে গিয়ে মহিলার
ক্রমেই জাগছে মনস্কাম;

ধূমাবতী মাতঙ্গী কমলা দশ-মহাবিদ্যা নিজেদের মুখ
দেখায়ে সমাপ্ত হলে সে তার নিজের ক্লান্ত পায়ের সংকেতে
পৃথিবীকে জীবনের মতো পরিসর দিতে গিয়ে
যাদের প্রেমের তরে ছিল আড়ি পেতে

তাহারা বিশেষ কেউ কিছু নয়,―
এখনো প্রাণের হিতাহিত
না জেনে এগিয়ে যেতে চেয়ে তোবু পিছে হটে গিয়ে
হেসে ওঠে গৌড়জনোচিত

গরম জলের কাপে ভবনের চায়ের দোকানে;
উত্তেজিত হয়ে মনে করেছিল (কবিদের হাড়
যতদূর উদবোধিত হয়ে যেতে পারে―
যদিও অনেক কবি প্রেমিকের হাতে স্ফীত হয়ে গেছে রাঁঢ়) :

‘উনিশশো বেয়াল্লিশ সালে এসে উনিশশো পঁচিশের জীব―
সেই নারী আপনার হংসীশ্বেত রিরংসার মতন কঠিন;
সে না হলে মহাকাল আমাদের রক্ত ছেঁকে নিয়ে
বার ক’রে নিত না কি জনসাধারণভাবে স্যাকারিন ।

আমাদের প্রাণে যেই অসন্তোষ জেগে ওঠে, সেই স্থির করে;
পুনরায় বেদনায় আমাদের সব মুখ স্থূল হয়ে গেলে
গাধার সুদীর্ঘ কান সন্দেহের চোখে দেখে তবু
শকুনের শেয়ালের চেকনাই কান কেটে ফেলে ।

 সামান্য মানুষ

  - জীবনানন্দ দাশ


একজন সামান্য মানুষকে দেখা যেত রোজ
ছিপ হাতে চেয়ে আছে; ভোরের পুকুরে
চাপেলি পায়রাচাঁদা মৌরলা আছে;
উজ্জ্বল মাছের চেয়ে খানিকটা দূরে
আমার হৃদয় থেকে সেই মানুষের ব্যবধান;
মনে হয়েছিল এক হেমন্তের সকালবেলায়;
এমন হেমন্ত ঢের আমাদের গোল পৃথিবীতে
কেটে গেছে; তবুও আবার কেটে যায়।

আমার বয়স আজ চল্লিশ বছর;
সে আজ নেই এ পৃথিবীতে;
অথবা কুয়াশা ফেঁসে—ওপারে তাকালে
এ রকম অঘ্রানের শীতে

সে সব রুপোলি মাছ জ্বলে ওঠে রোদে,
ঘাসের ঘ্রাণের মতো স্নিগ্ধ সব জল;
অনেক বছর ধরে মাছের ভিতরে হেসে খেলে
তবু সে তাদের চেয়ে এক তিল অধিক সরল,

এক বীট অধিক প্রবীণ ছিল আমাদের থেকে;
ঐখানে পায়চারি করে তার ভূত—
নদীর ভিতরে জলে তলতা বাঁশের
প্রতিবিম্বের মতন নিঁখুত;

প্রতিটি মাঘের হাওয়া ফাল্গুনের আগে এসে দোলায় সে সব।
আমাদের পাওয়ার ও পার্টি-পোলিটিক্স
জ্ঞান-বিজ্ঞানে আরেক রকম শ্রীছাঁদ।
কমিটি মিটিং ভেঙে আকাশে তাকালে মনে পড়ে—
সে আর সপ্তমী তিথি : চাঁদ।

আমি বেকার

  - জীবনানন্দ দাশ
 
  চারিদিকে রিট্রেঞ্চমেন্ট‌‌—বিজিনেট—ডিপ্রেশন
আমি বেকার
অনেক বছর ধ'রে কোনও কাজ নেই
কোথাও কাজ পাবার আশা নেই
একটা পয়সা খুঁজে বার করবার জন্য
আমার সমস্ত শক্তির প্রয়োজন হয়ে পড়েছে
পৃথিবী যেন বলছে : তোমার এই শক্তি : বরং তা
কবিতা লিখুক গিয়ে
আমি বলি : আমিও কবিতা লিখতেই চাই
কিন্তু পেটে কিছু পাব না কি
যার জোরে আশাপ্রদ কবিতা লিখতে পারা যায়
পৃথিবীর জয়গান ক'রে
কিন্তু তার বদলে পেটে কিছু পেতে চাই
পেটে কিছু পেতে চাই।


শকুন

   - জীবনানন্দ দাশ


 মাঠ থেকে মাঠে মাঠে - সমস্ত দুপুর ভ’রে এশিয়ার আকাশে আকাশে
শকুনেরা চরিতেছে; মানুষ দেখেছে হাট ঘাঁটি বস্তি—নিস্তব্ধ প্রান্তর
শকুনের; যেখানে মাঠের দৃঢ় নীরবতা দাঁড়ায়েছে আকাশের পাশে

আরেক আকাশ যেন,- সেইখানে শকুনেরা একবার নামে পরস্পর
কঠিন মেঘের থেকে - যেন দূর আলো ছেড়ে ধূম্র ক্লান্ত দিক্‌হস্তিগণ
প’ড়ে গেছে-প’ড়ে গেছে পৃথিবীতে এশিয়ার ক্ষেত মাঠ প্রান্তরের ’পরে

এইসব ত্যক্ত পাখিকয়েক মুহূর্ত শুধু - আবার করিছে আরোহণ
আঁধার বিশাল ডানা পাম্ গাছে,- পাহাড়ের শিঙে শিঙে সমুদ্রের পারে;
একবার পৃথিবীর শোভা দেখে - বোম্বায়ের সাগরের জাহাজ কখন

বন্দরের অন্ধকারে ভিড় করে, দেখে তাই -একবার স্নিগ্ধ মালাবারে
উড়ে যায় - কোন্ এক মিনারের বিমর্ষ কিনার ঘিরে অনেক শকুন
পৃথিবীর পাখিদের ভুলে গিয়ে চ’লে যায় যেন কোন্ মৃত্যুর ওপারে;

যেন কোন্ বৈতরণী অথবা এ জীবনের বিচ্ছেদের বিষণ্ণ লেগুন
কেঁদে ওঠে চেয়ে দেখে কখন গভীর নীলে মিশে গেছে সেইসব হূন।


আট বছর আগের একদিন

   - জীবনানন্দ দাশ

 শোনা গেল লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে - ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হল তার সাধ।

বধু শুয়ে ছিল পাশে -শিশুটিও ছিল;
প্রেম ছিল, আশা ছিল - জ্যোৎস্নায়—তবু সে দেখিল
কোন্‌ ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?
অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল - লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।

এই ঘুম চেয়েছিল বুঝি!
রক্তফেনা মাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি
আঁধার ঘুঁজির বুকে ঘুমায় এবার;
কোনোদিন জাগিবে না আর।

‘কোনোদিন জাগিবে না আর
জাগিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম - অবিরাম ভার
সহিবে না আর-’
এই কথা বলেছিল তারে
চাঁদ ডুবে চলে গেলে - অদ্ভুত আঁধারে
যেন তার জানালার ধারে
উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিস্তব্ধতা এসে।

তবুও তো পেঁচা জাগে;
গলিত স্থবির ব্যাঙ আরো দুই-মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে
আরেকটি প্রভাতের ইশারায় -অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে।

টের পাই যূথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে
চারি দিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা;
মশা তার অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থেকে জীবনের স্রোত ভালবেসে।

রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রৌদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি;
সোনালি রোদের ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা কত দেখিয়াছি।

ঘনিষ্ঠ আকাশ যেন - যেন কোন্‌ বিকীর্ণ জীবন
অধিকার করে আছে ইহাদের মন;
দুরন্ত শিশুর হাতে ফড়িঙের ঘন শিহরণ
মরণের সাথে লড়িয়াছে;
চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বত্থের কাছে
একগাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা একা;
যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের - মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা
এই জেনে।

অশ্বত্থের শাখা
করেনি কি প্রতিবাদ? জোনাকির ভিড় এসে
সোনালি ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে
করে নি কি মাখামাখি?
থুরথুরে অন্ধ পেঁচা এসে
বলে নি কি: ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে?
চমৎকার! -
ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার।’
জানায় নি পেঁচা এসে এ তুমুল গাঢ় সমাচার?

জীবনের এই স্বাদ—সুপক্ব যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের—
তোমার অসহ্য রোধ হল;
মর্গে - গুমোটে
থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্তমাখা ঠোঁটে!

শোনো তবু এ মৃতের গল্প; - কোনো
নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই;
বিবাহিত জীবনের সাধ
কোথাও রাখে নি কোনো খাদ,
সময়ের উদ্‌বর্তনে উঠে এসে বধূ
মধু - আর মননের মধু
দিয়েছে জানিতে;
হাড়হাভাতের গ্লানি বেদনার শীতে
এ জীবন কোনোদিন কেঁপে ওঠে নাই;
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের 'পরে।

জানি -তবু জানি
নারীর হৃদয় - প্রেম - শিশু -গৃহ - নয় সবখানি;
অর্থে নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয় -
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে
ক্লান্ত- ক্লান্ত করে;
লাশকাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই;
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের 'পরে।

তবু রোজ রাতে আমি চেয়ে দেখি, আহা,
থুরথুরে অন্ধ পেঁচা অশ্বত্থের ডালে বসে এসে,
চোখ পালটায়ে কয়: ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে?
চমৎকার!—
ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার -’
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজও চমৎকার? আমিও তোমার মতো বুড়ো হব -বুড়ি চাঁদটারে আমি
করে দেব কালীদহে বেনো জলে পার;
আমরা দুজনে মিলে শূন্যে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার।

 শতাব্দী

  - জীবনানন্দ দাশ

 চারদিকে নীল সাগর ডাকে অন্ধকারে,শুনি;
ঐখানেতে আলোকস্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে ঢের
একটি-দুটি তারার সাথে - তারপরেতে অনেকগুলো তারা;
অন্নে ক্ষুধা মিটে গেলেও মনের ভিতরের
ব্যথার কোনো মীমাংসা নেই জানিয়ে দিয়ে আকাশ ভ'রে জ্বলে;
হেমন্ত রাত ক্রমেই আরো অবোধ ক্লান্ত আধোগামী হয়ে
চলবে কি না ভাবতে আছে - ঋতুর কামচক্রে সে তো চলে;
কিন্তু কারো আশা আলো চলার আকাশ রয়েছে কি মানবহৃদয়ে ।
‌অথবা এ মানবপ্রাণের অনুতর্ক; হেমন্ত খুব স্থির
সপ্রতিভ ব্যাপ্ত হিরণগভীর সময় ব'লে
ইতিহাসের করুণ কঠিন ছায়াপাতের দিনে
উন্নতি প্রেম কাম্য মনে হ'লে
হৃদয়কে ঠিক শীত সাহসিক হেমন্তলোক ভাবি;
চারিদিকে রক্তে রৌদ্রে অনেক বিনিময়ে ব্যবহারে
কিছুই তবু ফল হল না; এসো মানুষ, আবার দেখা যাক
সময় দেশ ও সন্ততিদের কী লাভ হতে পারে।
ইতিহাসের সমস্ত রাত মিশে গিয়ে একটি রাত্রি আজ পৃথিবীর তীরে;
কথা ভাবায়, ভ্রান্তি ভাঙে, ক্রমেই বীতশোক
ক'রে দিতে পারে বুঝি মানবভাবনাকে;
অন্ধ অভিভূতের মতো যদিও আজ লোক
চলছে, তবু মানুষকে সে চিনে নিতে বলে :
কোথায় মধু―কোথায় কালের মক্ষিকারা - কোথায় আহ্বান
নীড় গঠনের সমবায়ের শান্তি-সহিষ্ণুতার -
মানুষও জ্ঞানী; তবুও ধন্য মক্ষিকাদের জ্ঞান ।
কাছে-দূরে এই শতাব্দীর প্রাণনদীর রোল
স্তব্ধ করে রাখে গিয়ে যে-ভূগোলের অসারতার পরে
সেখানে নীলকন্ঠ পাখি ফসল সূর্য নেই ,
ধূসর আকাশ, - একটি শুধু মেরুন রঙের গাছের মর্মরে
আজ পৃথিবীর শূন্য পথ ও জীবনবেদের নিরাশা তাপ ভয়
জেগে ওঠে - এ সুর ক্রমে নরম - ক্রমে হয়তো আরো কঠিন হতে পারে;
সোফোক্লেস ও মহাভারত মানবজাতির এ ব্যর্থতা জেনেছিল; জানি;
আজকে আলো গভীরতর হবে কি অন্ধকারে ।



No comments:

Post a Comment

Sunday, October 18, 2015

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ -- জীবনানন্দ দাশ

 

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ

- জীবনানন্দ দাশ

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই - প্রীতি নেই - করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব'লে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।


 সূর্যতামসী

- জীবনানন্দ দাশ

 কোথাও পাখির শব্দ শুনি;
কোনো দিকে সমুদ্রের সুর;
কোথাও ভোরের বেলা র'য়ে গেছে - তবে।
অগণন মানুষের মৃত্যু হ'লে - অন্ধকারে জীবিত ও মৃতের হৃদয়
বিস্মিতের মতো চেয়ে আছে;
এ কোন সিন্ধুর সুর:
মরণের - জীবনের?
এ কি ভোর?
অনন্ত রাত্রির মতো মনে হয় তবু।
একটি রাত্রির ব্যথা সয়ে -
সময় কি অবশেষে এ-রকম ভোরবেলা হয়ে
আগামী রাতের কালপুরুষের শস্য বুকে ক'রে জেগে ওঠে?
কোথাও ডানার শব্দ শুনি;
কোন দিকে সমুদ্রের সুর -
দক্ষিণের দিকে,
উত্তরের দিকে,
পশ্চিমের পানে?

সৃজনের ভয়াবহ মানে;
তবু জীবনের বসন্তের মতন কল্যাণে
সূর্যালোকিত সব সিন্ধু-পাখিদের শব্দ শুনি;
ভোরের বদলে তবু সেইখানে রাত্রি করোজ্জ্বল
ভিয়েনা, টোকিও, রোম, মিউনিখ - তুমি?
সার্থবাহ, সার্থবাহ, ওইদিকে নীল
সমুদ্রের পরিবর্তে আটলাণ্টিক চার্টার নিখিল মরুভূমি!
বিলীন হয় না মায়ামৃগ - নিত্য দিকদর্শিন;
যা জেনেছে - যা শেখেনি -
সেই মহাশ্মশানের গর্ভাঙ্কে ধূপের মত জ্ব'লে
জাগে না কি হে জীবন - হে সাগর -
শকুন্ত-ক্রান্তির কলরোলে।

 শীতরাত

 - জীবনানন্দ দাশ


এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে;
বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা,
কিংবা প্যাঁচার গান; সেও শিশিরের মতো, হলুদ পাতার মতো।

শহর ও গ্রামের দূর মোহনায় সিংহের হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে -
সার্কাসের ব্যথিত সিংহের।

এদিকে কোকিল ডাকছে - পউষের মধ্য রাতে;
কোনো-একদিন বসন্ত আসবে ব'লে?
কোনো-একদিন বসন্ত ছিলো, তারই পিপাসিত প্রচার?
তুমি স্থবির কোকিল নও? কত কোকিলকে স্থবির হ'য়ে যেতে দেখেছি,
তারা কিশোর নয়,
কিশোরী নয় আর;
কোকিলের গান ব্যবহৃত হ'য়ে গেছে।

সিংহ হুঙ্কার ক'রে উঠছে:
সার্কাসের ব্যথিত সিংহ,
স্থবির সিংহ এক - আফিমের সিংহ - অন্ধ - অন্ধকার।
চারদিককার আবছায়া-সমুদ্রের ভিতর জীবনকে স্মরণ করতে গিয়ে
মৃত মাছের পুচ্ছের শৈবালে, অন্ধকার জলে, কুয়াশার পঞ্জরে হারিয়ে যায় সব।

সিংহ অরন্যকে পাবে না আর
পাবে না আর
পাবে না আর
কোকিলের গান
বিবর্ণ এঞ্জিনের মত খ'শে খ'শে
চুম্বক পাহাড়ে নিস্তব্ধ।
হে পৃথিবী,
হে বিপাশামদির নাগপাশ, - তুমি
পাশ ফিরে শোও,
কোনোদিন কিছু খুঁজে পাবে না আর।

 মৃত্যু স্বপ্ন সংকল্প

 - জীবনানন্দ দাশ

 আমাদের জানা ছিলো কিছু;
কিছু ধ্যান ছিলো;
আমাদের উৎস-চোখে স্বপ্নছটা প্রতিভার মতো
হয়তো-বা এসে পড়েছিলো;
আমাদের আশা সাধ প্রেম ছিলো; - নক্ষত্রপথের
অন্তঃশূণ্যে অন্ধ হিম আছে জেনে নিয়ে
তবুও তো ব্রহ্মাণ্ডের অপরূপ অগ্নিশিল্প জাগে;
আমাদেরো গেছিলো জাগিয়ে
পৃথিবীতে;
আমরা জেগেছি - তবু জাগাতে পারিনি;
আলো ছিলো - প্রদীপের বেষ্টনী নেই;
কাজ ছিলো - শুরু হলো না তো;
তাহলে দিনের সিঁড়ি কি প্রয়োজনের?
নিঃস্বত্ব সূর্যকে নিয়ে কার তবে লাভ!
স্বচ্ছল শাণিত নদী, তীরে তার সারস-দম্পতি
ঐ জল ক্লান্তিহীন উৎসানল অনুভব ক'রে ভালোবাসে;
তাদের চোখের রং অনন্ত আকৃতি পায় নীলাভ আকাশে;
দিনের সূর্যের বর্ণে রাতের নক্ষত্র মিশে যায়;
তবু তারা প্রণয়কে সময়কে চিনেছে কি আজো?
প্রকৃতির সৌন্দর্যকে কে এসে চেনায়!

চারিদিকে প্রকৃতির

  - জীবনানন্দ দাশ

চারিদিকে প্রকৃতির ক্ষমতা নিজের মতো ছড়ায়ে রয়েছে।
সূর্য আর সূর্যের বনিতা তপতী—
মনে হয় ইহাদের প্রেম
মনে ক’রে নিতে গেলে, চুপে
তিমিরবিদারী রীতি হয়ে এরা আসে
আজ নয়—কোনো এক আগামী আকাশে।
অন্নের ঋণ,বিমলিন স্মৃতি সব
বন্দরবস্তির পথে কোনো এক দিন
নিমেষের রহস্যের মতো ভুলে গিয়ে
নদীর নারীর কথা—আরো প্রদীপ্তির কথা সব
সহসা চকিত হয়ে ভেবে নিতে গেলে বুঝি কেউ
হৃদয়কে ঘিরে রাখে, দিতে চায় একা আকাশের
আশেপাশে অহেতুক ভাঙা শাদা মেঘের মতন।
তবুও নারীর নাম ঢের দূরে আজ,
ঢের দূরে মেঘ;
সারাদিন নিলেমের কালিমার খারিজের কাজে মিশে থেকে
ছুটি নিতে ভালোবেসে ফেলে যদি মন
ছুটি দিতে চায় না বিবেক।
মাঝে মাঝে বাহিরের অন্তহীন প্রসারের
থেকে মানুষের চোখে-পড়া-না-পড়া সে কোনো স্বভাবের
সুর এসে মানবের প্রাণে
কোনো এক মানে পেতে চায়:
যে-পৃথিবী শুভ হতে গিয়ে হেরে গেছে সেই ব্যর্থতার মানে।
চারিদিকে কলকাতা টোকিয়ো দিল্লী মস্কৌ অতলান্তিকের কলরব,
সরবরাহের ভোর,
অনুপম ভোরাইয়ের গান;
অগণন মানুষের সময় ও রক্তের যোগান
ভাঙে গড়ে ঘর বাড়ি মরুভূমি চাঁদ
রক্ত হাড় বসার বন্দর জেটি ডক;
প্রীতি নেই—পেতে গেলে হৃদয়ের শান্তি স্বর্গের
প্রথম দুয়ারে এসে মুখরিত ক’রে তোলে মোহিনী নরক।
আমাদের এ পৃথিবী যতদূর উন্নত হয়েছে
ততদূর মানুষের বিবেক সফল।
সে চেতনা পিরামিডে পেপিরাসে-প্রিন্টিং-প্রেসে ব্যাপ্ত হয়ে
তবুও অধিক আধুনিকতর চরিত্রের বল।
শাদাসিদে মনে হয় সে সব ফসল:
পায়ের চলার পথে দিন আর রাত্রির মতন—
তবুও এদের গতি স্নিগ্ধ নিয়ন্ত্রিত ক’রে বার বার উত্তরসমাজ
ঈষৎ অনন্য সাধারণ।

 মহিলা

  - জীবনানন্দ দাশ

এইখানে শূন্যে অনুধাবনীয় পাহাড় উঠেছে
ভোরের ভিতর থেকে অন্য এক পৃথিবীর মতো;
‌এইখানে এসে প'ড়ে―থেমে গেলে― একটি নারীকে
কোথাও দেখেছি ব'লে স্বভাববশত

মনে হয়―কেননা এমন স্থান পাথরের ভারে কেটে তবু
প্রতিভাত হয়ে থাকে নিজের মতন লঘুভারে;
এইখানে সে দিনও সে হেঁটেছিল―আজও ঘুরে যায়;
এর ছেয়ে বেশি ব্যাখ্যা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন দিতে পারে;

অনিত্য নারীর রূপ বর্ণনায় যদিও সে কুটিল কলম
নিয়োজিত হয় নাই কোনোদিন―তবুও মহিলা
না ম'রে অমর যারা তাহাদের স্বর্গীয় কাপড়
কোঁচকায়ে পৃথিবীর মসৃণ গিলা

অন্তরঙ্গ ক'রে নিয়ে বানায়েছে নিজের শরীর ।
চুলের ভিতরে উঁচু পাহাড়ের কুসুম বাতাস ।
দিনগত পাপক্ষয় ভুলে গিয়ে হৃদয়ের দিন
ধারণ করেছে তার শরীরের ফাঁস ।

চিতাবাঘ জন্মাবার আগে এই পাহাড়ে সে ছিল;
অজগর সাপিনীর মরণের পরে ।
সহসা পাহাড় বলে মেঘখণ্ডকে
শূন্যের ভিতরে

‌ভুল হলে―প্রকৃতস্থ হয়ে যেতে হয়;
(চোখ চেয়ে ভালো করে তাকালেই হত;)
কেননা কেবলই যুক্তি ভালোবেসে আমি
প্রমাণের অভাববশত

তাহাকে দেখিনি তবু আজও;
এক আচ্ছন্নতা খুলে শতাব্দী নিজের মুখের নির্থলতা
দেখাবার আগে নেমে ডুবে যায় দ্বিতীয় ব্যথায়;
আদার ব্যাপারী হয়ে এইসব জাহাজের কথা

না ভেবে মানুষ কাজ করে যায় শুধু
ভয়াবহভাবে অনায়াসে
কখনো সম্রাট শনি শেয়াল ও ভাঁড়
সে নারীর রাং দেখে হো-হো ক̓রে হাসে ।

২.

মহিলা তবুও নেমে আসে মনে হয় ;
(বমারের কাজ সাঙ্গ হলে
নিজের এয়োরোড্রোমে―প্রান্তির মতো?)
আছেও জেনেও জনতার কোলাহলে

তাহার মনের ভাব ঠিক কী রকম―
আপনারা স্থির করে নিন;
মনে পড়ে, সেন রায় নওয়াজ কাপুর
আয়াঙ্গার আপ্তে পেরিন―

এমনি পদবী ছিল মেয়েটির কোনো একদিন;
আজ তবু উনিশশো বেয়াল্লিশ সাল;
সম্বর মৃগের বেড় জড়ায়েছে যখন পাহাড়ে
কখনো বিকেলবেলা বিরাট ময়াল,

অথবা যখন চিল শরতের ভোরে
নীলিমার আধপথে তুলে নিয়ে গেছে
রসুয়েকে ঠোনা দিয়ে অপরূপ চিতলের পেটি,―
সহসা তাকায়ে তারা উৎসারিত নারীকে দেখেছে;

এক পৃথিবীর মৃত্যু প্রায় হয়ে গেলে
অন্য-এক পৃথিবীর নাম
অনুভব ক'রে নিতে গিয়ে মহিলার
ক্রমেই জাগছে মনস্কাম;

ধূমাবতী মাতঙ্গী কমলা দশ-মহাবিদ্যা নিজেদের মুখ
দেখায়ে সমাপ্ত হলে সে তার নিজের ক্লান্ত পায়ের সংকেতে
পৃথিবীকে জীবনের মতো পরিসর দিতে গিয়ে
যাদের প্রেমের তরে ছিল আড়ি পেতে

তাহারা বিশেষ কেউ কিছু নয়,―
এখনো প্রাণের হিতাহিত
না জেনে এগিয়ে যেতে চেয়ে তোবু পিছে হটে গিয়ে
হেসে ওঠে গৌড়জনোচিত

গরম জলের কাপে ভবনের চায়ের দোকানে;
উত্তেজিত হয়ে মনে করেছিল (কবিদের হাড়
যতদূর উদবোধিত হয়ে যেতে পারে―
যদিও অনেক কবি প্রেমিকের হাতে স্ফীত হয়ে গেছে রাঁঢ়) :

‘উনিশশো বেয়াল্লিশ সালে এসে উনিশশো পঁচিশের জীব―
সেই নারী আপনার হংসীশ্বেত রিরংসার মতন কঠিন;
সে না হলে মহাকাল আমাদের রক্ত ছেঁকে নিয়ে
বার ক’রে নিত না কি জনসাধারণভাবে স্যাকারিন ।

আমাদের প্রাণে যেই অসন্তোষ জেগে ওঠে, সেই স্থির করে;
পুনরায় বেদনায় আমাদের সব মুখ স্থূল হয়ে গেলে
গাধার সুদীর্ঘ কান সন্দেহের চোখে দেখে তবু
শকুনের শেয়ালের চেকনাই কান কেটে ফেলে ।

 সামান্য মানুষ

  - জীবনানন্দ দাশ


একজন সামান্য মানুষকে দেখা যেত রোজ
ছিপ হাতে চেয়ে আছে; ভোরের পুকুরে
চাপেলি পায়রাচাঁদা মৌরলা আছে;
উজ্জ্বল মাছের চেয়ে খানিকটা দূরে
আমার হৃদয় থেকে সেই মানুষের ব্যবধান;
মনে হয়েছিল এক হেমন্তের সকালবেলায়;
এমন হেমন্ত ঢের আমাদের গোল পৃথিবীতে
কেটে গেছে; তবুও আবার কেটে যায়।

আমার বয়স আজ চল্লিশ বছর;
সে আজ নেই এ পৃথিবীতে;
অথবা কুয়াশা ফেঁসে—ওপারে তাকালে
এ রকম অঘ্রানের শীতে

সে সব রুপোলি মাছ জ্বলে ওঠে রোদে,
ঘাসের ঘ্রাণের মতো স্নিগ্ধ সব জল;
অনেক বছর ধরে মাছের ভিতরে হেসে খেলে
তবু সে তাদের চেয়ে এক তিল অধিক সরল,

এক বীট অধিক প্রবীণ ছিল আমাদের থেকে;
ঐখানে পায়চারি করে তার ভূত—
নদীর ভিতরে জলে তলতা বাঁশের
প্রতিবিম্বের মতন নিঁখুত;

প্রতিটি মাঘের হাওয়া ফাল্গুনের আগে এসে দোলায় সে সব।
আমাদের পাওয়ার ও পার্টি-পোলিটিক্স
জ্ঞান-বিজ্ঞানে আরেক রকম শ্রীছাঁদ।
কমিটি মিটিং ভেঙে আকাশে তাকালে মনে পড়ে—
সে আর সপ্তমী তিথি : চাঁদ।

আমি বেকার

  - জীবনানন্দ দাশ
 
  চারিদিকে রিট্রেঞ্চমেন্ট‌‌—বিজিনেট—ডিপ্রেশন
আমি বেকার
অনেক বছর ধ'রে কোনও কাজ নেই
কোথাও কাজ পাবার আশা নেই
একটা পয়সা খুঁজে বার করবার জন্য
আমার সমস্ত শক্তির প্রয়োজন হয়ে পড়েছে
পৃথিবী যেন বলছে : তোমার এই শক্তি : বরং তা
কবিতা লিখুক গিয়ে
আমি বলি : আমিও কবিতা লিখতেই চাই
কিন্তু পেটে কিছু পাব না কি
যার জোরে আশাপ্রদ কবিতা লিখতে পারা যায়
পৃথিবীর জয়গান ক'রে
কিন্তু তার বদলে পেটে কিছু পেতে চাই
পেটে কিছু পেতে চাই।


শকুন

   - জীবনানন্দ দাশ


 মাঠ থেকে মাঠে মাঠে - সমস্ত দুপুর ভ’রে এশিয়ার আকাশে আকাশে
শকুনেরা চরিতেছে; মানুষ দেখেছে হাট ঘাঁটি বস্তি—নিস্তব্ধ প্রান্তর
শকুনের; যেখানে মাঠের দৃঢ় নীরবতা দাঁড়ায়েছে আকাশের পাশে

আরেক আকাশ যেন,- সেইখানে শকুনেরা একবার নামে পরস্পর
কঠিন মেঘের থেকে - যেন দূর আলো ছেড়ে ধূম্র ক্লান্ত দিক্‌হস্তিগণ
প’ড়ে গেছে-প’ড়ে গেছে পৃথিবীতে এশিয়ার ক্ষেত মাঠ প্রান্তরের ’পরে

এইসব ত্যক্ত পাখিকয়েক মুহূর্ত শুধু - আবার করিছে আরোহণ
আঁধার বিশাল ডানা পাম্ গাছে,- পাহাড়ের শিঙে শিঙে সমুদ্রের পারে;
একবার পৃথিবীর শোভা দেখে - বোম্বায়ের সাগরের জাহাজ কখন

বন্দরের অন্ধকারে ভিড় করে, দেখে তাই -একবার স্নিগ্ধ মালাবারে
উড়ে যায় - কোন্ এক মিনারের বিমর্ষ কিনার ঘিরে অনেক শকুন
পৃথিবীর পাখিদের ভুলে গিয়ে চ’লে যায় যেন কোন্ মৃত্যুর ওপারে;

যেন কোন্ বৈতরণী অথবা এ জীবনের বিচ্ছেদের বিষণ্ণ লেগুন
কেঁদে ওঠে চেয়ে দেখে কখন গভীর নীলে মিশে গেছে সেইসব হূন।


আট বছর আগের একদিন

   - জীবনানন্দ দাশ

 শোনা গেল লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে - ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হল তার সাধ।

বধু শুয়ে ছিল পাশে -শিশুটিও ছিল;
প্রেম ছিল, আশা ছিল - জ্যোৎস্নায়—তবু সে দেখিল
কোন্‌ ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?
অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল - লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।

এই ঘুম চেয়েছিল বুঝি!
রক্তফেনা মাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি
আঁধার ঘুঁজির বুকে ঘুমায় এবার;
কোনোদিন জাগিবে না আর।

‘কোনোদিন জাগিবে না আর
জাগিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম - অবিরাম ভার
সহিবে না আর-’
এই কথা বলেছিল তারে
চাঁদ ডুবে চলে গেলে - অদ্ভুত আঁধারে
যেন তার জানালার ধারে
উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিস্তব্ধতা এসে।

তবুও তো পেঁচা জাগে;
গলিত স্থবির ব্যাঙ আরো দুই-মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে
আরেকটি প্রভাতের ইশারায় -অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে।

টের পাই যূথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে
চারি দিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা;
মশা তার অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থেকে জীবনের স্রোত ভালবেসে।

রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রৌদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি;
সোনালি রোদের ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা কত দেখিয়াছি।

ঘনিষ্ঠ আকাশ যেন - যেন কোন্‌ বিকীর্ণ জীবন
অধিকার করে আছে ইহাদের মন;
দুরন্ত শিশুর হাতে ফড়িঙের ঘন শিহরণ
মরণের সাথে লড়িয়াছে;
চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বত্থের কাছে
একগাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা একা;
যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের - মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা
এই জেনে।

অশ্বত্থের শাখা
করেনি কি প্রতিবাদ? জোনাকির ভিড় এসে
সোনালি ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে
করে নি কি মাখামাখি?
থুরথুরে অন্ধ পেঁচা এসে
বলে নি কি: ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে?
চমৎকার! -
ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার।’
জানায় নি পেঁচা এসে এ তুমুল গাঢ় সমাচার?

জীবনের এই স্বাদ—সুপক্ব যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের—
তোমার অসহ্য রোধ হল;
মর্গে - গুমোটে
থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্তমাখা ঠোঁটে!

শোনো তবু এ মৃতের গল্প; - কোনো
নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই;
বিবাহিত জীবনের সাধ
কোথাও রাখে নি কোনো খাদ,
সময়ের উদ্‌বর্তনে উঠে এসে বধূ
মধু - আর মননের মধু
দিয়েছে জানিতে;
হাড়হাভাতের গ্লানি বেদনার শীতে
এ জীবন কোনোদিন কেঁপে ওঠে নাই;
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের 'পরে।

জানি -তবু জানি
নারীর হৃদয় - প্রেম - শিশু -গৃহ - নয় সবখানি;
অর্থে নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয় -
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে
ক্লান্ত- ক্লান্ত করে;
লাশকাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই;
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের 'পরে।

তবু রোজ রাতে আমি চেয়ে দেখি, আহা,
থুরথুরে অন্ধ পেঁচা অশ্বত্থের ডালে বসে এসে,
চোখ পালটায়ে কয়: ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে?
চমৎকার!—
ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার -’
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজও চমৎকার? আমিও তোমার মতো বুড়ো হব -বুড়ি চাঁদটারে আমি
করে দেব কালীদহে বেনো জলে পার;
আমরা দুজনে মিলে শূন্যে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার।

 শতাব্দী

  - জীবনানন্দ দাশ

 চারদিকে নীল সাগর ডাকে অন্ধকারে,শুনি;
ঐখানেতে আলোকস্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে ঢের
একটি-দুটি তারার সাথে - তারপরেতে অনেকগুলো তারা;
অন্নে ক্ষুধা মিটে গেলেও মনের ভিতরের
ব্যথার কোনো মীমাংসা নেই জানিয়ে দিয়ে আকাশ ভ'রে জ্বলে;
হেমন্ত রাত ক্রমেই আরো অবোধ ক্লান্ত আধোগামী হয়ে
চলবে কি না ভাবতে আছে - ঋতুর কামচক্রে সে তো চলে;
কিন্তু কারো আশা আলো চলার আকাশ রয়েছে কি মানবহৃদয়ে ।
‌অথবা এ মানবপ্রাণের অনুতর্ক; হেমন্ত খুব স্থির
সপ্রতিভ ব্যাপ্ত হিরণগভীর সময় ব'লে
ইতিহাসের করুণ কঠিন ছায়াপাতের দিনে
উন্নতি প্রেম কাম্য মনে হ'লে
হৃদয়কে ঠিক শীত সাহসিক হেমন্তলোক ভাবি;
চারিদিকে রক্তে রৌদ্রে অনেক বিনিময়ে ব্যবহারে
কিছুই তবু ফল হল না; এসো মানুষ, আবার দেখা যাক
সময় দেশ ও সন্ততিদের কী লাভ হতে পারে।
ইতিহাসের সমস্ত রাত মিশে গিয়ে একটি রাত্রি আজ পৃথিবীর তীরে;
কথা ভাবায়, ভ্রান্তি ভাঙে, ক্রমেই বীতশোক
ক'রে দিতে পারে বুঝি মানবভাবনাকে;
অন্ধ অভিভূতের মতো যদিও আজ লোক
চলছে, তবু মানুষকে সে চিনে নিতে বলে :
কোথায় মধু―কোথায় কালের মক্ষিকারা - কোথায় আহ্বান
নীড় গঠনের সমবায়ের শান্তি-সহিষ্ণুতার -
মানুষও জ্ঞানী; তবুও ধন্য মক্ষিকাদের জ্ঞান ।
কাছে-দূরে এই শতাব্দীর প্রাণনদীর রোল
স্তব্ধ করে রাখে গিয়ে যে-ভূগোলের অসারতার পরে
সেখানে নীলকন্ঠ পাখি ফসল সূর্য নেই ,
ধূসর আকাশ, - একটি শুধু মেরুন রঙের গাছের মর্মরে
আজ পৃথিবীর শূন্য পথ ও জীবনবেদের নিরাশা তাপ ভয়
জেগে ওঠে - এ সুর ক্রমে নরম - ক্রমে হয়তো আরো কঠিন হতে পারে;
সোফোক্লেস ও মহাভারত মানবজাতির এ ব্যর্থতা জেনেছিল; জানি;
আজকে আলো গভীরতর হবে কি অন্ধকারে ।



No comments:

Post a Comment