পালকি - তুমি যাচ্ছ পালকিতে, মা, চ’ড়ে
কালের বিবর্তনে উন্নত হচ্ছে সভ্যতা। কতো কিছু পাল্টায় , পাল্টায় সংস্কৃতি, সভ্যতা সেই সঙ্গে পাল্টে যায় মানুষের জীবনধারা।ইন্নত হয় যানবাহন,উন্নত হয় সমাজ।সমাজের এই পরিবর্তনের রেশ ধরেই হারিয়ে যায় গ্রাম বাংলার সংস্কৃতির সুপরিচিত অনেক পুরনো ঐতিহ্য। এই হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের মধ্যে পালকি অন্যতম।
পালকি নিয়ে সত্যেন্দ্র নাথ দত্ত একটি সুন্দর কবিতা লিখেছেন ..
কবিতা-পালকির গান
পাল্কী চলে!
পাল্কী চলে!
গগন-তলে
আগুন জ্বলে!
স্তব্ধ গাঁয়ে
আদুল গায়ে
যাচ্ছে কারা
রৌদ্রে সারা
ময়রামুদি
চক্ষু মুদি’
পাটায় ব’সে
ঢুলছে ক’ষে।
দুধের চাঁছি
শুষছে মাছি,
উড়ছে কতক
ভনভনিয়ে।
আসছে কা’রা
হন্ হনিয়ে?
হাটের শেষে
রুক্ষ বেশে
ঠিক দু’পুরে
ধায় হাটুরে!
কুকুর গুলো
শুঁকছে ধূলো,
ধুঁকছে কেহ
ক্লান্ত দেহ।
গঙ্গা ফড়িং
লাফিয়ে চলে;
বাঁধের দিকে
সূর্য্য ঢলে।
পাল্কী চলে রে,
অঙ্গ টলেরে!
আর দেরি কত?
আর কত দূর?
... তাছাড়া আরো সুন্দর ছন্দবদ্ধ কথা .রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বীর পুরুষ’কবিতায় পাওয়া যায় ..
মনে করো, যেন বিদেশ ঘুরে
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।
তুমি যাচ্ছ পালকিতে, মা, চ’ড়ে
দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে,
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার ‘পরে
টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে।
রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে
রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে।।
সন্ধে হল, সূর্য নামে পাটে,
এলেম যেন জোড়াদিঘির মাঠে।
ধূ ধূ করে যে দিক-পানে চাই,
কোনখানে জনমানব নাই,
তুমি যেন আপন-মনে তাই
ভয় পেয়েছ – ভাবছ, ‘এলেম কোথা।’
আমি বলছি, ‘ভয় কোরো না মাগো,
ওই দেখা যায় মরা নদীর সোঁতা।’
আমরা কোথায় যাচ্ছি কে তা জানে -
অন্ধকারে দেখা যায় না ভাল।
তুমি যেন বললে আমায় ডেকে,
‘দিঘির ধারে ওই-যে কিসের আলো!’
এমন সময় ‘হাঁ রে রে রে রে’
ওই-যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে!
তুমি ভয়ে পালকিতে এক কোণে
ঠাকুর-দেবতা স্মরণ করছ মনে,
বেয়ারাগুলো পাশের কাঁটাবনে
পালকি ছেড়ে কাঁপছে থরোথরো।
আমি যেন তোমায় বলছি ডেকে,
আমি আছি, ভয় কেন, মা, করো!’
তুমি বললে, ‘যাসনে খোকা ওরে,’
আমি বলি, ‘দেখো-না চুপ করে।’
ছুটিয়ে ঘোড়া গেলেম তাদের মাঝে,
ঢাল তলোয়ার ঝনঝনিয়ে বাজে,
কী ভয়ানক লড়াই হল মা যে
শুনলে তোমার গায়ে দেবে কাঁটা।
কত লোক যে পালিয়ে গেল ভয়ে,
কত লোকের মাথা পড়ল কাটা।।
এত লোকের সঙ্গে লড়াই করে,
ভাবছ খোকা গেলই বুঝি মরে।
আমি তখন রক্ত মেখে ঘেমে
বলছি এসে, ‘লড়াই গেছে থেমে,’
তুমি শুনে পালকি থেকে নেমে
চুমো খেয়ে নিচ্ছ আমায় কোলে
বলছ, ‘ভাগ্যে খোকা সঙ্গে ছিল’
কী দুর্দশাই হত তা না হলে!’
গানের কথা মনে হলে,মনে পড়ে যায়,ভূপেন হাজারিকার দোলা গানটি..
দোলা, হে দোলা-
হে দোলা, হে দোলা।
আঁকা-বাঁকা পথে মোরা
কাঁধে নিয়ে ছুটে যাই
রাজা-মহারাজাদের দোলা।
আমাদের জীবনের-
ঘামে ভেজা শরীরের বিনিময়ে
পথ চলে দোলা।
হেঁইয়া না- হেঁইয়া না-
হেঁইয়া না- হেঁইয়া!
হেঁইয়া না- হেঁইয়া না-
হেঁইয়া না- হেঁইয়া!
দোলার ভিতরে ঝলমল করে যে
সুন্দর পোশাকের সাজ-
আর, ফিরে ফিরে দেখি তাই,
ঝিকমিক করে যে,
মাথায় রেশমের তাজ।
হায় মোর ছেলেটির
উলঙ্গ শরীরে
একটিও জামা নেই তোলা।
দুচোখে জল এলে মনটাকে বেঁধে যে
তবু বয়ে যাই দোলা।
হে দোলা-
হে দোলা, হে দোলা।
হেঁইয়া না- হেঁইয়া না-
হেঁইয়া না- হেঁইয়া!
হেঁইয়া না- হেঁইয়া না-
হেঁইয়া না- হেঁইয়া!
যুগে যুগে ছুটি মোরা কাঁধে নিয়ে দোলাটি,
দেহ ভেঙে ভেঙে পড়ে
যুগে যুগে ছুটি মোরা কাঁধে নিয়ে দোলাটি,
দেহ ভেঙে ভেঙে পড়ে।
ঘুমে চোখ ঢুলু-ঢুলু রাজা-মহারাজাদের
আমাদের ঘাম ঝরে পড়ে।
উঁচু ওই পাহাড়ে ধীরে-ধীরে উঠে যাই
ভাল করে পায়ে পা মেলা।
হঠাৎ কাঁধের থেকে পিছলিয়ে যদি পড়ে
আর দোলা যাবে না তো তোলা-
রাজা-মহারাজার দোলা-
বড় বড় মানুষের দোলা।
হে দোলা-
হে দোলা, হে দোলা।
আঁকা-বাঁকা পথে মোরা
কাঁধে নিয়ে ছুটে যাই
রাজা-মহারাজাদের দোলা।
হে দোলা-
হে দোলা, হে দোলা।
হেঁইয়া না- হেঁইয়া না-
হেঁইয়া না- হেঁইয়া!
হেঁইয়া না- হেঁইয়া না-
হেঁইয়া না- হেঁইয়া!
গানটিতে দোলা পালকির কথাই বুঝানো হয়েছে।