একজন মিনতি রানীর হৃদয় বিদারক কাহিনী
সত্য ঘটনা অবলম্বনে।খুবই সুন্দরী ছিলে তুমি, মিনতি। ছোটখাট গড়নের; ফর্সা রং, টিকলো নাক, টানা চোখ; সব মিলিয়ে কী যে একটা মায়া ছড়িয়ে ছিল তোমার সারা শরীরটা জুড়ে। সবাই তোমার মাকে বলতো, "দেখিস লক্ষী, তোর মেয়ে একদিন রাজরানী হবে"। মা গর্বভরে জবাব দিত, " তাতো হবেই, তোমরা দেখে নিও। তাইতো নাম রেখেছি, রাণী, মিনতি রাণী।"
মায়ের গর্ব শেষ হয়না। বয়স তের না পেরতেই সমন্ধ আসে নানা জায়গা থেকে। অবশেষে চৌদ্দ না পেরতেই বিয়ে দিতেই হ'ল মিনতিকে। রাষ্ট্রের সহৃদয় কর্মচারিদের কল্যাণে মিনতির বয়স কোন বাঁধাই হয়ে দাঁড়াতে পারেনি এ বিয়ের বেলায়। তাই, নেহায়েত বাধ্য হয়েই তাকে মায়ের কোল ছেড়ে আসতে হলো কিশোরগঞ্জের কটিয়াদিতে। মেয়েদের আসল আশ্রয়, স্বামীর বাড়ি। স্বামীটিও বেশ, বয়েস বিশের কোটায়, নকশি কাঁথার রুপাই এর মত। শ্যামলা, মিষ্টি চেহারা, সব কাজের কাজি। দোষের মধ্যে কেবল একটাই, আসলে কোন কাজ নেই, বেকার ভবঘুরে।
গল্পটি এখানে শেষ হতে পারতো, কিন্তু দয়াময় সৃষ্টিকর্তার যে গূঢ় রহস্যে মানবজীবন আবর্তিত হয় তার খানিক ভেদ নির্ণয়ে হয়তো মিনতি রাণীর প্রয়োজন ছিল। যদিও তার জীবনের চরম পরিণতির সুদূরতম সাক্ষী হিসেবে আমার কি প্রয়োজন ছিল তার কারণ নির্ণয়ের ব্যর্থ প্রচেষ্টায় আমার বাকী জীবনও ব্যয়িত হবে।
গল্পটি আসলে এ পর্যন্তই, বাকিটা গল্প নয় নিরেট বাস্তবতা।
উপজেলা ম্যাজিস্টেট হিসেবে যোগ দিয়েছি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদিতে। মনের মতো কাজ। মানুষকে জেলে ঢুকাই, বের করে আনি, কাউকে জামিন দেই, কাউকে দেইনা। তবে, নিজেও তেমন জামিন পাইনা। সকাল ১০ টায় এজলাসে বসে ঠান্ডা মাথায় নতুন মামলার অভিযোগ শুনি। কোনটাতে সমন, কোনটাতে গ্রেফতারি আর বেশির ভাগই তদন্তে পাঠাই। তারপর শুনি জামিন। কোন আসামী কোর্টে আত্মসমর্পন করেছে, কোনটাকে আনা হয়েছে জেলখানা থেকে। কারো বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ, কারো ডাকাতির কেউ বা খুনের আসামি। মামলা শুনতে শুনতে মাথা গরম হয়ে আসলে খাস কামরায় একটু বিশ্রাম। দুপরের খাবারের সামান্য বিরতির পর দিনের প্রথমার্ধের ঘোষিত আদেশগুলো নথিতে সম্পূর্ণ লিখে রাখা। দিনের দ্বিতীয়ার্ধে প্রায়শ: সাক্ষী থাকে, যা ফেরত দেয়া সমীচীন নয়। কাজের মধ্যে আরেকটা ছিল উর্ধ্বতন আদালতের আদেশ প্রতিপালন করা। যাদের সামর্থ্য আছে তারা নিম্ন আদালতের বিচারাধীন মামলা মহামান্য হাইকোর্টে নিয়ে ফেলে রাখতে পারেন বছরের পর বছর। সেখানে দুর্বল প্রতিপক্ষের করণীয় তেমন নেই। এরকম আদেশভুক্ত নথিগুলো পেশকার আলাদা করে রাখেন। এভাবে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের কিছুটা প্রহর কাটিয়ে প্রায়ই বাসায় ফিরতাম ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে। সময়মতো লিখতে না পারা কিছু নথিও নিয়ে আসতাম অবসর বিনোদনের জন্যে। আর সপ্তাহের ছুটির দিনগুলোর প্রায় সবকটিই যেতো রায় লিখায়। কোন কোন মহামান্য বিচারক যেমন রায় না দিয়ে বছরের পর বছর মামলা ফেলে রাখতে পারেন; আমাদের মতো নিম্ন আদালতে সে সুযোগ তেমন ছিলনা। তারপরেও আনন্দ ছিল, বিবেকমতো কাজ করতে পারার। মনে হত কাজ করছি, মানুষের জন্য।
একটা মামলায় মহামান্য হাইকোর্টের উপর্যুপরি কয়টি আদেশ দেখেছি, প্রতিবারই কয়েকমাস করে স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। আদেশের গায়ে স্বাক্ষর করে তা বাস্তবায়নের জন্য পেশকারের হাতে দেই। তিনি তা যথাস্থানে তুলে রাখেন। বুঝলাম এটি একটি হত্যা মামলা। আসামীপক্ষ মামলাটি প্রায় দু'বছর ধরে একতরফাভাবে স্থগিত করে রেখেছেন। মহামান্য আদালতের ইংরেজীতে দেয়া আদেশ স্পষ্ট এবং সংক্ষিপ্ত; বাংলায় প্রায় এরকম, "প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট আদালত কটিয়াদির --- নম্বর মামলার স্থগিতাদেশের মেয়াদ আরো দুইমাস বর্ধিত করা হইল"।
এরকমই চলছিল। হঠাৎ একদিন একই মামলার এজাতীয় আরেকটি আদেশ পেয়ে মামলাটির বিষয়ে জানতে চাইলে পেশকার জানালেন এটি এ্যাডভোকেট ঘোষবাবুর মামলা। তিনি ঘোষবাবুকে খাস কামরায় আমার সালাম পৌঁছালেন। ঘোষবাবু জানালেন এটি হত্যা মামলা; ভেরি ইন্টারেস্টিং এবং করুণ ঘটনা। সোলেমান চেয়ারম্যান(ছদ্ম নাম) বর্তমান চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলাটি। তিনি এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের বিরুদ্ধে তার নিজ গাঁয়ের একটি হিন্দু মেয়েকে ধর্ষনের পর হত্যার অভিযোগে এ মামলাটির উদ্ভব হয়। বিশদ জানার জন্য নথিটি বাসায় নিয়ে গেলাম।
বাসায় ফিরে কোনমতে হাতমুখ ধুয়ে নথিটি নিয়ে বসলাম। মেয়েটির নাম মিনতি রানী। বাড়ি, পার্শ্ববর্তী জেলা ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায়। সদ্য বিয়ে হয়ে এ গাঁয়ে এসেছে। স্বামীটি আমড়া কাঠের ঢেঁকি, লেখাপড়া সামান্য; এখনো বাপের হোটেলেই খায়। জমিজমা বর্গা দেয়া, তাই কাজ বিশেষ নেই। এখন সুযোগ পেলেই নতুন বউ নিয়ে পাশের গাঁয়ের আত্মীয় বাড়ীতে যায়। ফেরার পথে গ্রাম্য বাজার থেকে সস্তা চূড়ি, চিরুনি কেনে বউয়ের জন্য। বউটি খুবই সুন্দরী, রাস্তায় বের হলে সবাই তাকায়। এখন তার মান মর্যাদাই আলাদা। মা বাবার একমাত্র ছেলে, টাকাকড়ি বিশেষ নেই, যে জমিজমা আছে তাতে ছোট সংসার কোনমতে চলে। তবে ছেলের আনন্দেই মা বাবার সুখ। ভগবান চাইলে আর কটা দিন! মেয়ে কটিরও বিয়ে হয়ে গেছে।
ওদের স্বামীর বাড়ী বেশ দূরে, হিন্দু মেয়েদের জন্য জাতপাত মিলানো ঢের কঠিন। আড়ে থেকে
পর পর কয়দিন মেয়েটিকে দেখলো চেয়ারম্যান। তারপর সুযোগমতো একা পেয়ে প্রস্তাব, সেই সাথে নানা প্রলোভন।