একজন মিনতি রানীর হৃদয় বিদারক কাহিনী
সত্য ঘটনা অবলম্বনে।খুবই সুন্দরী ছিলে তুমি, মিনতি। ছোটখাট গড়নের; ফর্সা রং, টিকলো নাক, টানা চোখ; সব মিলিয়ে কী যে একটা মায়া ছড়িয়ে ছিল তোমার সারা শরীরটা জুড়ে। সবাই তোমার মাকে বলতো, "দেখিস লক্ষী, তোর মেয়ে একদিন রাজরানী হবে"। মা গর্বভরে জবাব দিত, " তাতো হবেই, তোমরা দেখে নিও। তাইতো নাম রেখেছি, রাণী, মিনতি রাণী।"
মায়ের গর্ব শেষ হয়না। বয়স তের না পেরতেই সমন্ধ আসে নানা জায়গা থেকে। অবশেষে চৌদ্দ না পেরতেই বিয়ে দিতেই হ'ল মিনতিকে। রাষ্ট্রের সহৃদয় কর্মচারিদের কল্যাণে মিনতির বয়স কোন বাঁধাই হয়ে দাঁড়াতে পারেনি এ বিয়ের বেলায়। তাই, নেহায়েত বাধ্য হয়েই তাকে মায়ের কোল ছেড়ে আসতে হলো কিশোরগঞ্জের কটিয়াদিতে। মেয়েদের আসল আশ্রয়, স্বামীর বাড়ি। স্বামীটিও বেশ, বয়েস বিশের কোটায়, নকশি কাঁথার রুপাই এর মত। শ্যামলা, মিষ্টি চেহারা, সব কাজের কাজি। দোষের মধ্যে কেবল একটাই, আসলে কোন কাজ নেই, বেকার ভবঘুরে।
গল্পটি এখানে শেষ হতে পারতো, কিন্তু দয়াময় সৃষ্টিকর্তার যে গূঢ় রহস্যে মানবজীবন আবর্তিত হয় তার খানিক ভেদ নির্ণয়ে হয়তো মিনতি রাণীর প্রয়োজন ছিল। যদিও তার জীবনের চরম পরিণতির সুদূরতম সাক্ষী হিসেবে আমার কি প্রয়োজন ছিল তার কারণ নির্ণয়ের ব্যর্থ প্রচেষ্টায় আমার বাকী জীবনও ব্যয়িত হবে।
গল্পটি আসলে এ পর্যন্তই, বাকিটা গল্প নয় নিরেট বাস্তবতা।
উপজেলা ম্যাজিস্টেট হিসেবে যোগ দিয়েছি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদিতে। মনের মতো কাজ। মানুষকে জেলে ঢুকাই, বের করে আনি, কাউকে জামিন দেই, কাউকে দেইনা। তবে, নিজেও তেমন জামিন পাইনা। সকাল ১০ টায় এজলাসে বসে ঠান্ডা মাথায় নতুন মামলার অভিযোগ শুনি। কোনটাতে সমন, কোনটাতে গ্রেফতারি আর বেশির ভাগই তদন্তে পাঠাই। তারপর শুনি জামিন। কোন আসামী কোর্টে আত্মসমর্পন করেছে, কোনটাকে আনা হয়েছে জেলখানা থেকে। কারো বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ, কারো ডাকাতির কেউ বা খুনের আসামি। মামলা শুনতে শুনতে মাথা গরম হয়ে আসলে খাস কামরায় একটু বিশ্রাম। দুপরের খাবারের সামান্য বিরতির পর দিনের প্রথমার্ধের ঘোষিত আদেশগুলো নথিতে সম্পূর্ণ লিখে রাখা। দিনের দ্বিতীয়ার্ধে প্রায়শ: সাক্ষী থাকে, যা ফেরত দেয়া সমীচীন নয়। কাজের মধ্যে আরেকটা ছিল উর্ধ্বতন আদালতের আদেশ প্রতিপালন করা। যাদের সামর্থ্য আছে তারা নিম্ন আদালতের বিচারাধীন মামলা মহামান্য হাইকোর্টে নিয়ে ফেলে রাখতে পারেন বছরের পর বছর। সেখানে দুর্বল প্রতিপক্ষের করণীয় তেমন নেই। এরকম আদেশভুক্ত নথিগুলো পেশকার আলাদা করে রাখেন। এভাবে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের কিছুটা প্রহর কাটিয়ে প্রায়ই বাসায় ফিরতাম ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে। সময়মতো লিখতে না পারা কিছু নথিও নিয়ে আসতাম অবসর বিনোদনের জন্যে। আর সপ্তাহের ছুটির দিনগুলোর প্রায় সবকটিই যেতো রায় লিখায়। কোন কোন মহামান্য বিচারক যেমন রায় না দিয়ে বছরের পর বছর মামলা ফেলে রাখতে পারেন; আমাদের মতো নিম্ন আদালতে সে সুযোগ তেমন ছিলনা। তারপরেও আনন্দ ছিল, বিবেকমতো কাজ করতে পারার। মনে হত কাজ করছি, মানুষের জন্য।
একটা মামলায় মহামান্য হাইকোর্টের উপর্যুপরি কয়টি আদেশ দেখেছি, প্রতিবারই কয়েকমাস করে স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। আদেশের গায়ে স্বাক্ষর করে তা বাস্তবায়নের জন্য পেশকারের হাতে দেই। তিনি তা যথাস্থানে তুলে রাখেন। বুঝলাম এটি একটি হত্যা মামলা। আসামীপক্ষ মামলাটি প্রায় দু'বছর ধরে একতরফাভাবে স্থগিত করে রেখেছেন। মহামান্য আদালতের ইংরেজীতে দেয়া আদেশ স্পষ্ট এবং সংক্ষিপ্ত; বাংলায় প্রায় এরকম, "প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট আদালত কটিয়াদির --- নম্বর মামলার স্থগিতাদেশের মেয়াদ আরো দুইমাস বর্ধিত করা হইল"।
এরকমই চলছিল। হঠাৎ একদিন একই মামলার এজাতীয় আরেকটি আদেশ পেয়ে মামলাটির বিষয়ে জানতে চাইলে পেশকার জানালেন এটি এ্যাডভোকেট ঘোষবাবুর মামলা। তিনি ঘোষবাবুকে খাস কামরায় আমার সালাম পৌঁছালেন। ঘোষবাবু জানালেন এটি হত্যা মামলা; ভেরি ইন্টারেস্টিং এবং করুণ ঘটনা। সোলেমান চেয়ারম্যান(ছদ্ম নাম) বর্তমান চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলাটি। তিনি এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের বিরুদ্ধে তার নিজ গাঁয়ের একটি হিন্দু মেয়েকে ধর্ষনের পর হত্যার অভিযোগে এ মামলাটির উদ্ভব হয়। বিশদ জানার জন্য নথিটি বাসায় নিয়ে গেলাম।
বাসায় ফিরে কোনমতে হাতমুখ ধুয়ে নথিটি নিয়ে বসলাম। মেয়েটির নাম মিনতি রানী। বাড়ি, পার্শ্ববর্তী জেলা ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায়। সদ্য বিয়ে হয়ে এ গাঁয়ে এসেছে। স্বামীটি আমড়া কাঠের ঢেঁকি, লেখাপড়া সামান্য; এখনো বাপের হোটেলেই খায়। জমিজমা বর্গা দেয়া, তাই কাজ বিশেষ নেই। এখন সুযোগ পেলেই নতুন বউ নিয়ে পাশের গাঁয়ের আত্মীয় বাড়ীতে যায়। ফেরার পথে গ্রাম্য বাজার থেকে সস্তা চূড়ি, চিরুনি কেনে বউয়ের জন্য। বউটি খুবই সুন্দরী, রাস্তায় বের হলে সবাই তাকায়। এখন তার মান মর্যাদাই আলাদা। মা বাবার একমাত্র ছেলে, টাকাকড়ি বিশেষ নেই, যে জমিজমা আছে তাতে ছোট সংসার কোনমতে চলে। তবে ছেলের আনন্দেই মা বাবার সুখ। ভগবান চাইলে আর কটা দিন! মেয়ে কটিরও বিয়ে হয়ে গেছে।
ওদের স্বামীর বাড়ী বেশ দূরে, হিন্দু মেয়েদের জন্য জাতপাত মিলানো ঢের কঠিন। আড়ে থেকে
পর পর কয়দিন মেয়েটিকে দেখলো চেয়ারম্যান। তারপর সুযোগমতো একা পেয়ে প্রস্তাব, সেই সাথে নানা প্রলোভন।
সাধ্যমতো এড়িয়ে চলতো সে। এখন তার আগের সেই চপলতা নেই; ভীতি আর জড়তা আড়ষ্ট করেছে তাকে। স্বামীকেও কিছু বলতে পারেনি সে। চেয়ারম্যান সুযোগ সন্ধানে আড়ে আড়ে, থাকে। একদিন কী এক সামান্য অসুখ করলে স্থানীয় বাজারে গ্রাম্য ডাক্তারের কাছে অষুধের জন্যে যায় মিনতি। চেয়ারম্যানের একলোক ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে যায় একদিকে, অন্যলোক মিনতির স্বামীকে ডেকে নিয়ে আটকে রাখে অন্যত্র। ডাক্তারের ছোট ঘরটিতে এখন শুধু মিনতি, একা। পরিকল্পনামতো চেয়ারম্যানের আগমন ও অসহায় মিনতির শ্লীলতাহানি।
কম বয়সে বিয়ে হয়েছিল মিনতির, তাই অসহায় হরিণ শাবক যেমন চিতাবাঘের ছলাকলা বুঝতে পারার আগেই তার শিকারে পরিনত হয়; মিনতির হয়েছিল সেরকম। মা বাবার নিরাপদ আশ্রয় থেকে যারা তাকে এনেছিল তারাও ছিল তারই মত অসহায়। অন্তত গ্রাম দস্যুদের হাতে। যদি সে আরো চার কিংবা পাঁচ বছর পর এ লোকালয়ে আসতো তাহলে লোকালয়ের পশু চরিত্রগুলো তার কম বেশি জানা থাকতো। হয়তো তখন সে নিজের পরবর্তী বিয়োগান্তক পরিনতি থেকে আত্ম রক্ষার পথ খুঁজে নিতে পারত।
ডাক্তারের দোকানের ঘটনার পর ক্ষুব্দ, অপমানিত মিনতি আরেকটি বড় ভুল করে ফেলল। তার নারীত্বের লাঞ্চনার জন্য সে বিচার প্রার্থী হল কিনা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। আসামীর নাম পরিচয় পেয়ে শ্বশুরবাড়ীর লোকজনের অবস্থান স্পষ্ট; 'বাঁচতে হবে তো আমাদের; জীবন না মানসম্মান, কোনটা আগে'? কিন্তু মিনতি নাবুঝ; তার বিচার চাইই চাই। নাহলে, এখানে আর একদন্ডও নয়। তার নিজ গ্রামে বাড়ীর পাশে আম, জাম, নারকেল গাছ আর বটগাছের তলায় বিচরণশীল ছাগ শিশুগুলোর কথা তার এখন বেশি বেশি মনে পড়তে লাগল। শ্বশুর শ্বাশুরির আদর পেয়ে এতদিন মা বাবার কথা ভুলে থাকত সে। এখন মনে হল এখানে তার কেউ নেই। স্বামীকে বলল সে 'আমাকে বাড়ীতে দিয়ে আস'। সে বাড়ীর সবাই এটাকে সুযোগ হিসেবেই দেখল। যাক, ঘুরে আসুক না বাপের বাড়ি থেকে। সবাই জানে, সময় সব দু:খেরই নিরাময় করে। পরের দিন --- রেল স্টেশনেই গাড়ীতে উঠতে হবে। সঙ্গে শুধু স্বামীই যাবে অন্য কেহ নয়। কে জানে বাপের বাড়িতে যেয়ে এ মেয়ে ঘটনার কতটুকু রটনা করবে!
বাপের বাড়ি কোনদিন যাওয়া হয়নি মিনতির। তার স্বামী সদাচঞ্চল ---কেও আর কোথাও কেহ দেখতে পায়নি কোনদিন। দিন কয়েক পরে বাস রেল স্টেশন থেকে বেশ দূরে একটি পুকুরের নালার পানিতে ভেসে উঠলো একটি লাশ। প্রথমে লম্বা চুল দেখতে পেল সবাই, তারপর লাশের শরীর; একটি কমবয়েসী মেয়ের। চারিটি হাত-পা দড়ি দিয়ে মাটিতে পুঁতে রাখা খুটির সাথে শক্ত করে বাঁধা। পানির নীচে
বেনামি আসামীর বিরুদ্ধে দুর্বল পুলিশি মামলা। কাকের মাংস কাকে খায়না প্রবাদটি অসত্য প্রমান করে একজন হিন্দু ওসি সম্ভাব্য আসামীদের সবাইকে বাঁচার সুযোগ করে দিয়ে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় মামলাটিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে দেয়। বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশি প্রতিবেদন গ্রহণ না করে স্বত:প্রণোদিত হয়ে এটিকে নালিশি মামলায় রুপান্তরিত করেন। অত:পর মেয়েটির বাবা এবং শ্বশুর বাড়ীর কয়েকজনের জবানবন্দী নিয়ে মূল আসামী চেয়ারম্যানসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আমলে নেন। এবং সকল আসামীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারী করেন। আসামীপক্ষ ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশের বিরুদ্ধে জেলা দায়রা জজ আদালতে গেলে বিজ্ঞ দায়রা জজ ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশটিই বহাল রাখেন। অতপর: আসামীগণ মহামান্য হাইকোর্টের আশ্রয়ে যেয়ে নৃশংস খুনের এ জঘন্য মামলাটির বিচার প্রক্রিয়া সূচনাতেই বন্ধ করে দিতে সমর্থ হয়।
নথির কাগজগুলো পড়ছিলাম আর রুমালের চোখ মুছছিলাম। বার কয়েক অন্য অছিলায় বেসিনে চোখ ধুয়ে এসেছি। এবার ভিকটিমের সুরতহাল ও পোস্টমর্টেম রিপোর্টে চোখ বুলালাম। কীভাবে হত্যা করা হয়েছিল মেয়েটিকে! ধর্ষনের পর গলাটিপে কিংবা গামছা বেঁধে শ্বাসরোধ করে কিংবা প্রতিহিংসায় নেহায়েত পিটিয়ে? পোস্ট মর্টেমে কি লিখা আছে! ভালভাবে পুরোটা পড়ার আগেই অবরুদ্ধ আবেগে আমার চোখে অশ্রু ধারার সাথে একটি অস্ফুট অবরুদ্ধ চীৎকার করে আমি শিশুর মতো বিহ্বল অসহায় হয়ে কাঁদতে শুরু করলাম। বুকের ভেতর থেকে উদগত কান্নার তোড়ে আমার সমগ্র শরীর ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছিল। শব্দ শুনে স্ত্রী এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার কষ্টের কারণ জানতে চাইল। কথা বলতে পারলামনা; তাকে নথিটার উল্টানো পাতায় পোস্ট মর্টেম রিপোর্টটার প্রতি ইঙ্গিত করলাম। আমার স্ত্রী আইন পড়েছেন; কিছুদিন উকালতিও করে ছিলেন। নথিতে চোখ বুলিয়ে বিষয়টি আঁচ করতে তার সময় লাগেনি। চেয়ারম্যান তার পাঁচ ছয়জন সাঙ্গপাঙ নিয়ে মেয়েটিকে সারারাত নৃশংসভাবে ধর্ষন করেছে। ধর্ষনের পর হত্যার আগে বা পরে তার দুটি স্তন ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে শরীর থেকে সমান করে বিচ্ছিন্ন করেছে। তার বুক, পেটসহ সারা শরীর ধারালো ছুরির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত।
মেয়েটির গোপনাঙ্গে এবং এর চারপাশে ধারালো অস্ত্রের প্রচন্ড আঘাত মাংসপেশী ভেদ করে পেছনের হাঁড় পর্যন্ত বিদ্ধ করেছে। অকল্পনীয় নৃশংসতা। নিজের চোখে রিপোর্টটি না দেখলে আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতাম না।
সে রাতে সুস্থির হতে আমার দীর্ঘ সময় লেগেছিল। সত্যি বলতে কী, পুরোপুরি সুস্থির আমি আর কোনদিনই হইনি। তারপর বহুদিন মেয়েটির জীবনের শেষ রাতটির কথা স্মরণ করে আমি দীর্ঘসময় ভারাক্রান্ত থেকেছি। অস্বীকার করবোনা, কেঁদেছিও বহুবার। আজকেও ওর কথা লিখতে যেয়ে বারবার চোখ মুছেছি, বারকয়েক চোখও ধুয়েও এসেছি। আগের মতই বিহ্বলতায় আক্রান্ত হয়েছি একাধিকবার।
আমি কোনভাবেই হিসেব মিলাতে পারিনা কী ভাবে একটি জনসমাজ কতটুকু অধ:পতিত হলে, জীবনবোধ তৈরী হবার আগেই একটি কচি বালিকা এমন নৃশংসতার শিকার হতে পারে। মেয়েটিতো রাতের আঁধারে হারিয়ে যায়নি। প্রকাশ্য রাস্তা থেকে তাকে আর তার জীবনসঙ্গীকে ধরে নেয়া হয়েছে। রাতের আগে দিনের সময়টায় কোথায় দুটো জীবিত মানুষকে লুকিয়ে রাখা সম্ভব হল। রাতের আঁধারে একটি মেয়ের উপর সুদীর্ঘ সময় ধরে পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হল তখন কি তার আর্তনাদ কোন মানুষের কানে পৌঁছেনি। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস এ ঘটনা কেউ না কেউ দেখেছিল, কেউ না কেউ শুনেও ছিল; কিন্তু সবল প্রতিপক্ষের বিরুপতার কাপুরুষোচিত ভয়ে কেউ মুখ খুলেনি। রাষ্ট্রের কর্ণধার থেকে চৌকিদার, দফাদার সবাই যখন সুসুপ্তিতে নিমগ্ন, বিচারকের দায়ভার নিয়ে বিচারক এবং হাকিম বাহাদুরগণ যখন গভীর নিদ্রামগ্ন, তখন সারাদেশ জুড়ে তাদের দুর্বল প্রজাকুল হিংস্র হায়েনাদের গ্রাস হয়ে কী অসহায়, অরক্ষিত জীবন যাপন করে তার প্রমান এই মিনতি ও তার স্বামী।
মিনতি, আমার প্রচন্ড প্রত্যাশা ছিল, যারা তোমাকে এমন নৃশংসতায় হত্যা করেছে তাদের বিচার হবে এবং কঠোর শাস্তি হবে। আমি হাইকোর্টে মামলাটির খোঁজ নিতেও চেয়েছিলাম। আগে ভাবতাম মামলার ঘটনাস্থল থেকে আমার আকস্মিক স্থানান্তর আমাকে সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে। কিন্তু জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় মনে হয় আমার ধারণা সঠিক ছিলনা। শত চেষ্টা সত্ত্বেও আমি হয়তো কিছুই করতে পারতাম না। কেবলি মনে হয়, এদেশে কিংবা সারা পৃথিবীর কোথাও দুর্বলদের জন্য ন্যায় বিচারের কোন পথ কেউ খোলা রাখেনি। 'জোর যার মুল্লুক তার' এ নীতি পৃথিবীর সর্বত্র সর্বদাই কার্যকর ছিল। শুধু প্রয়োগ পদ্ধতিটি ভিন্নতর হয়েছে। কোথাও এটি বেশি স্পষ্ট, কোথাও তত দৃশ্যমান নয়।
মিনতি, তোমাকে আমি কখনো দেখিনি। তারপরও আমার অন্তর থেকে তোমার একটা ছবি এঁকেছি। জানিনা আমার লেখা পড়ে তুমি নিজকে চিনতে পারবে কিনা।
শুনেছিলাম তোমার নিহত হবার সংবাদ পেয়ে তোমার বাবা কটিয়াদি এসে সবার দ্বারে দ্বারে ঘুরেছিলেন। মামলার সন্ধানে তিনি একবার হাইকোর্টেও গিয়েছিলেন। কিন্তু মহামান্য হাইকোর্ট, অনেক উঁচু। সেখানে বাদী বিবাদী নয় বরং বিচার হয় নথি দেখে। আর সবকিছু যেখানে বিদেশী ভাষায়, সেখানে বাংলায় সাইনবোর্ড পড়া তোমার বাবা তোমার খুনের মামলার আসামী কোন আদালত থেকে অবাধে চলার স্বাধীনতা হাসিল করেছে তার সন্ধান সারা জীবনেও করতে পারবেনা এতে আমি প্রায় নিশ্চিত।
মিনতি আমার ধারণা, হয়তো আমার কষ্ট কোন ক্ষেত্রে তোমার বাবা মার চেয়েও বেশি হয়ে থাকতে পারে। তারা হত্যার কথা জানে, কিন্তু কী পৈশাচিক নিষ্ঠুরতায় তোমাকে ওরা মেরেছে সে কথা হয়তো ওরা জানতে পারেন নি। কারণ, তারা আমার মতো পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট পড়েননি। মাঝে মাঝে ভাবি আমারই বা কেমন দায় পড়েছিল এ অবাঞ্চিত কুতূহলের! তোমাকে স্মরণ করে কাঁদার জন্য এতদিনে হয়ত তোমার মাবাপও বেঁচে নেই। কিন্তু মিনতি, তুমি আমার জন্য দু:খের অবিরল ঝর্ণা হয়ে আমার মাঝে বেঁচে থাকবে। তুমি একরাতে যে নির্যাতন সয়েছ গত ২৫ বছরে আমি যে ব্যথা বয়ে বেড়িয়েছি তা একসাথে করলে হয়তো তুলনায় নেহায়েত কম হবেনা।
মিনতি, আমার দু:খের স্থায়ী উৎস হিসেবে তোমাকে উপস্থাপন করে আমি হয়তো আরেকটা অন্যায় করেছি। তবে সত্যিকার বিশ্বাস থেকে বলছি, তুমি একইসাথে আমার একটি বড় শিক্ষা এবং বৃহৎ অনুপ্রেরণারও উৎস। আমাদের সমাজপতিগণ সুযোগ পেলে কীরকম ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে সে বিষয়ে তুমিই প্রথম আমার চোখ খুলে দিয়েছিলে। আমি পরবর্তীতে আমার সকল কর্মে, সকল কর্মস্থলে আমার চোখ খোলা রেখেছিলাম। তাই, কারো চোখ রাঙানিতে কিংবা চাকচিক্যে আমি বিভ্রান্ত হইনি। তোমার চরম দু:খ আমাকে দু:খ জয় করতে শিখিয়েছে। কর্মজীবনের শেষ প্রান্তে এসেও আমার মনে হচ্ছে কিসের বঞ্চনা আমার! আমরা যারা বিচারে ছিলাম, প্রশাসনে ছিলাম, কথাতো ছিল আমরা তোমাদের সুখ দেব, নিরাপত্তা দেব কিংবা কমপক্ষে একটা ন্যায়বিচার দেব। তার কিছুই যখন দিতে পারিনি তখন আমি অন্তত যা পেয়েছি তা আমার প্রাপ্যতার চেয়ে ঢের বেশি বলেই মনে করি। তোমাদের কথা ভাবলে নিজকে আমি কখনো অসুখী ভাবতে পারি না। আমি মনে করি কেবল পরোপকার এবং দু:খ জয়ের মাধ্যমেই মানুষ আনন্দে বেঁচে থাকতে পারে।
হে সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ, সর্বগামী, জগতের প্রতিপালক, বিপদ হন্তারক; পৃথিবীর সব মানুষ যখন অভাগা মেয়েটির প্রতি মুখ ফিরিয়েছিল তখন সে কি আপনার করুণা প্রার্থনা করে নাই! আপনার কত স্তাবক, হুকুম বরদার সর্বত্র ব্যাপ্ত হয়ে আছে! আচমিতার এ গ্রামটিতে একটি অবলা গ্রাম্য বালিকাকে সকলের অগোচরে নির্মম, নিষ্ঠুর নির্যাতনে জর্জরিত করছিল, আপনারই সৃষ্ট কতিপয় পাষন্ড; আপনি তা জানতেন। আর কিছু নাহোক, আপনার দৃশ্য অদৃশ্য অসংখ্য অনুচরদের কোন একজন ভূত সেজে ঘটনাস্থলের কাছে যেয়ে হেঁড়ে গলায় কিংবা নাসিকা ধ্বনিতে বলতো, 'কাঁজটি ভাঁল হঁচ্ছেনা চেঁয়ারম্যান', তখনি তো বীর পুঙ্গবটি তাদের পরিধেয় বস্ত্র ফেলে পড়িমরি পালাতো। সকালে গ্রামবাসীগণ পরিত্যক্ত বস্ত্র দেখে তাদের পরিচয় জানতে পারতো। আপনার নির্লিপ্ততায় আপনার সকল মহিমা মসীলিপ্ত হয়েছে। অথবা দু:খি মেয়েটির ভাগ্য কি আপনি এভাবেই লিখেছিলেন! বৃদ্ধ ওমর ক্ষেপে গিয়ে তাই বলেছিলেন,
"প্রথম থেকেই আছে লেখা, অদৃষ্টে তোর যা হবার,
তার সে কলম দিয়ে, যিনি সুখে দুখে নির্বিকার"!
বাংলার বাউলরাও কী তাই আপনার প্রতি অভিমান করে বলেছে,
"কেহ বলে আছ তুমি, কেহ বলে নাই;
আমি বলি থাকলে থাক, না থাকিলে নাই"!
হে সর্বশক্তিমান অসহায় মিনতির প্রতি আপনার অকরুণ নিস্পৃহতা আমার বিশ্বাসের ভিতকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। আপনি ক্ষমাশীল; যদি সত্য বলে থাকি, আমাকে ক্ষমা করুন।
প্রিয় পাঠক বন্ধুগণ, মিনতি রানীর করুণ পরিনতি জানার পর বহু বছর আমার কোন শান্তনা ছিলনা। কেবলই ভেবেছি এসমাজ, এ রাষ্ট্র কারো নিষ্ঠুর নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে চালিত হচ্ছে। একজন ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে আমার ব্যর্থতার গ্লানি আমাকে নির্মম পেষনে জর্জরিত করছিল। শান্তনা পরে আমি ঠিকই পেয়েইছিলাম, দুটি বই থেকে। আমার জীবনের সেরা দু'টি বই। একটি টলস্টয়ের, অন্যটি জনাথন সুইফটের; একটি 'পুনরুজ্জীবন' (Resurrection), অপরটি 'গালিভারের সফরনামা'(Gulliver's Travels). সম্প্রতি কয়েকবছর ধরে এ তালিকায় আরেকটি যোগ হয়েছে, এরিস্টটলের 'রাজনীতি' (Politics). সুইফটের বইটি বাল্যকালে আমাদের ভীষন বিভ্রান্ত করেছে। মূল বইটির বাংলা অনুবাদ আমি পাইনি। আমি এটি ভাষান্তরের চেষ্টা করছি। সামনে কোন একদিন বইটির ভাষান্তরিত কিছু অনুচছেদ আপনাদের মতামতের জন্য উপস্থাপন করব বলে আশা রাখি। বইটির গুরুত্ব অনুধাবনে এর যে কোন একটি অনুচ্ছেদই যথেষ্ট বলে আমার মনে হয়। দেখি আপনারা কী বলেন!
জনাব,Jafor Siddique মহোদয়ের ফেসবুকের ওয়াল থেকে সংগৃহীত।
No comments:
Post a Comment