মালির পথে
ইবনে বতুতার রোমাঞ্চকর অভিযান
আইওয়ালাতানে থাকতে আর ভাল লাগছে না।ভাবলাম দেশে ফিরে যাব।কিন্ত পরে চিন্তা করলাম এদের রাজধানী না দেখে গেলে কেমন হয় !তাই মালি সফরের প্রস্তুতি নিলাম আইওয়ালাতান থেকে মালির দূরত্ব দ্রুত গতিতে গেলে চব্বিশ দিনের পথ।বিশাল এক মরুভূমি পাড়ি দিতে হবে।আমি একজন পথ প্রদর্শক ভাড়া করে রওয়ানা হলাম।আমার সাথে আরোও তিন জন ছিলেন।একটি বন এলাকা দিয়ে আমরা চলেছি।বড় বড় গাছের সারির ভেতর দিয়ে পথ চলে গিয়েছে।গাছগুলোর কান্ড বিশালাকায়।কোন কোন গাছের ডালপালা এতা বিস্তৃত যে একটি গাছের ছায়াতেই একটি কাফেলার সবাই বিশ্রাম নিতে পারে।কোন কোন গাছে কোন পাতা নেই।কিন্তু কান্ড এতো বিশাল যে এর ছায়াতেই মুসাফিররা বিশ্রাম নিতে পারে।এই এলাকার এক লোকের গাছ দেখলাম কান্ড বিশালাকায় ,বোতলাকৃতির এবং ভিতরে ফাঁপা।সেই ফাঁপা স্থানে বৃষ্টির পানি জমা থাকে।যেন একটি পানির কূপ!মুসাফিররা গাছের কান্ড ফুটো করে সেই পানি পান করতে পারে।আবার কোন কোন গাছের ফাঁপা অংশে মৌমাছিরা মৌচাক তৈরী করে।ওখান থেকে প্রচুর মধু পা্ওয়া যায়।এক জায়গায় আমি দেখলাম এক গাছের ফাঁপা অংশের বিশাল ফাটলে এক তাঁতী তার তাঁত দিয়ে ভেতরে বসে আরামে বসে বুনন কাজ করছে।এই দৃশ্য দেখে আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম।আইওয়ালাতান ও মালির মধ্যবর্তী এলাকার জঙ্গলে বিভিন্ন রকমের ফল মূলের গাছ জন্মে।এখানে আপেল,নাশপাতি,খুবানী,শাফতালু গাছের মতো গাছ দেখা যায়।কিন্তু আসলে এগুলো অন্য গাছ।এ এলাকায় খরবুজার মতো এক জাতের ফল উতপন্ন হয়।পাকলে ফেটে যায় এবং ভিতবে আঠার মতো পদার্থ পা্ওয়া যায়।এই ফলগুলো রান্না করে খাওয়া হয়।বাজারেও বিক্রী হয়।মাটির নীচে শিমের বিচির মতো একধরনের শষ্য জন্মে।এগুলোকে ভেজে খাওয়া যায়।নাশপাতির মতো দেখতে গারতি নামে এক জাতের ফল জন্মে।যা খেতে অত্যন্ত মিষ্টি।এর বিচি থেকে তেলও পাওয়া যায়।এই তেল ভাজা,রান্না,চেরাগ জ্বালানো,গায়ে মাখা এবং এক জাতের মাটির সাথে মিশিয়ে পুটিন বানানোর কাজেও ব্যবহৃত হয়।এই তেল এই এলাকায় প্রচুর উতপন্ন হয়।লাউয়ের খোলের ভিতর বিভিন্ন শহরে নিয়ে যাওয়া হয়।এখানে বিশালাকৃতি লাউয়ের খোল শুকিয়ে পাত্র বানানো হয়। যা একটি বড় কলসির সমান হয়।এই এলাকায় সফরের সময় মুসাফিররা নিজেদের মালপত্র,খাবার দাবার বা টাকা পয়সা সাথে নেয় না।টাকা পয়সার বদলে নিয়ে যায় লবণের টুকরো আর সীসার অলংকার।সীসার তৈরী অলংকারকে বলা হয় নাজম।এছাড়া বিভিন্ন সুগন্ধি দ্রব্যও নিয়ে যাওয়া হয়।মুসাফিরদের কাফেলা কোন গ্রামে গিয়ে পৌঁছলে কৃষ্ণাঙ্গ রমণীরা ভূট্টা,চাল,দুধ,মুরগী,বরবটি,শিমের আটা,সরষের মতো দেখতে দানাদার শষ্য ফুনি প্রভৃতি নিয়ে আসেন।লবন,সীসার অলংকার ও সুগন্ধী দ্রব্যের বিনিময়ে এগুলো মুসাফিররা পছন্দ মতো কিনে নেন।
দশ দিন পর আমরা জাগনী নামে এক জনপদে এসে পৌঁছলাম।এখানে সাগবাগো সম্প্রদায়ের বসবাস।এরা কৃষ্ণাঙ্গ এবং আবাজিয়া।খারেজী মাজহাবের অনুসারী।এখানে মালেকি মাজহাবের লোকজনকে তুরি বলা হয় ।জাগরী থেকে আমরা পৌছালাম নাইজার নদীতে।মালি সম্রাজ্যের প্রধান নদী এই নাইজার।এই নদীর তীরে বিভিন্ন শহর গড়ে উঠেছে আমরা নাইজার তীরবর্তী কারসাখু কাবারাহ হয়ে জাগাহ পৌঁছলাম।কারবাহ ও জাগাহ দুইটি এলাকার দুজন রাজা শাসন করেন ।দুই জনেই মালির সুলতানের অধীন।জাগাহর কৃষ্ণাঙ্গরা প্রচীনকাল থেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন।এরা অত্যন্ত পরহেজগার এবং বিদ্যুতসাহী।জাগাহ থেকে নাইজার নদী এখান দিয়ে ঘুরে তুমবুকত ও কাউকাউ হয়ে মুলিতে পৌঁছেছে।মুলিতে লিমি উপউপজাতীয়দের বসবাস। এই এলাকা হলো মালি সম্রাজ্যের শেষ সীমা।নাইজার নদী এখান থেকে ঘুরে ইউফি শহরে পৌঁছেছে।এই এলাকা থেকে শুরু হয়েছে কৃষ্ণাঙ্গ কাফেরদের এলাকা।এখানকার রাজাকে কৃষ্ণাঙ্গ কাফেরদের সবচেয়ে বড় রাজা হিসাবে গণ্য করা হয়।শ্বেতকায়রা এই এলাকায় যায় না।কারণ গেলেই কৃষ্ণাঙ্গ কাফেররা হামলা করে ওদেরকে কতল করে ফেলে ।
ইউফি থেকে নাইজার নদী লোবা এলাকায় প্রবাহিত হয়েছে।এই এলাকার জনগণ খ্রিষ্টান। এরপর নাইজার নদী পৌঁছেছে দুনকুলা শহরে।এটি কৃষ্ণঙ্গদের সবচেয়ে বড় শহর।এখানকার সুলতানের নাম ইবনে কানজুদ্দিন।মিশরের সুলতান মালেক নাসেরের সময় ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন ।এরপর নাইজার জানাদিল এলাকায় এসে সাগরে মিশেছে ।
কর্টেসী-মোহাম্মদ মামুনূর রশীদ
No comments:
Post a Comment