প্লাষ্টিক বোতল জনস্বাস্থের জন্য কতটা নিরাপদ ? নিচের ত্রিকোণ চিহ্নের অর্থ জানেন ? ক্ষতি না চাইলে জেনে নিন ।
ঘরে বাইরে এখন প্লাস্টিকের পেট বোতলের ছড়াছড়ি। খাবার রাখা থেকে পানি রাখা— সবকিছুতেই এই প্লাস্টিক বোতল। কিন্তু, কখনও আমরা কেউ খেয়াল করি না প্লাস্টিকের বোতলের গায়ে থাকা চিহ্নগুলিকে।
পড়ে গেলে চট করে ফেটে যায় না। বোতল পরিষ্কার করাও সহজ। ব্যবহারের এমন সোজা-সাপটা সুবিধায় প্লাস্টিকের বোতলের চল বাড়তে বাড়তে এখন জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্লাস্টিক কি?
“প্লাস্টিক” শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ “প্লাস্টিকস” থেকে যার অর্থ স্বচ্ছন্দে যে কোন আঁকার দেয়া যায় এমন কিছু। ১৮৪৫ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার পার্কস নাইট্রো-সেলুলোজ, প্লাস্টিসাইজার ও অন্য দ্রাবক পদার্থের মিশ্রণে তৈরি করেন আজকের এই প্লাস্টিক। প্লাস্টিক মূলত কার্বন যৌগের একটি চলমান শিকলের জটিল গঠন যার মূল উপাদানে রয়েছে কার্বনের সাথে অক্সিজেন, নাইট্রোজেন এবং সালফারের জটিল রাসায়নিক বন্ধন। এই প্লাস্টিক তার প্রতুলতা, সহজলভ্যতা, তুলনামূলক ব্যয়সাশ্রয়ী এবং পরিবহন, ভঙ্গুরতা সহনশীল সহ আরও অনেক কারণে প্রচলিত অন্যান্য সকল উপাদান টপকে আজকের বহুল ব্যবহৃত উপাদানের স্থানে অধিষ্ঠিত হয়েছে।
প্লাস্টিকের প্রকারভেদ
আমাদের চারপাশে আমরা নানান রকম প্লাস্টিক দেখতে পাই। এগুলোর মধ্যে রয়েছে এক্রেলিক্স, পলিসটার, সিলিকন, পলিউইরেথিন, হ্যালোজেনেটেড প্লাস্টিক ইত্যাদি। মূলত প্লাস্টিকের মূল প্রকারভেদ হয় দুটি বিভাগেঃ থার্মোপ্লাস্টিক (যে প্লাস্টিক একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় তার আকৃতি পরিবর্তন করে এবং শীতল হয়ে সেই আকারের কঠিন আকৃতি ধারন করে) এবং থার্মোসেটিং প্লাস্টিক (এটা মূলত পেট্রো ক্যামিক্যাল যা ২০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা বা তার উপরে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় নির্দিষ্ট রূপে প্লাস্টিক যৌগ গঠন করে)।
ফুড গ্রেডেড প্লাস্টিক
আমাদের চারিপাশের দৃশ্যমান প্লাস্টিক পণ্যের সবগুলোই কিন্তু পেট্রোলিয়াম বা প্রাকৃতিক গ্যাস হতে সৃষ্ট। তাই বলে সকল প্লাস্টিক সমগোত্রীয়? আপনার পানীয় বোতল আর গাড়ির টায়ার? আসলে না, মূল গঠন উপাদান কার্বন যৌগ হলেও বিস্তর ফারাক রয়েছে উপরোক্ত দুটি পণ্যে। আজকের দিনে “ফুড গ্রেড প্লাস্টিক” শব্দটির সাথে আমরা সবাই কমবেশী পরিচিত, তাই না? আসলে ফুড গ্রেড প্লাস্টিক কি? ফুড গ্রেড প্লাস্টিক মূলত এইচডিপিই (উচ্চ ঘনত্বের পলি ইথিলিন) যা দীর্ঘ সময়ব্যাপী ১১০ ডিগ্রী তাপমাত্রা পর্যন্ত রাসায়নিক বিক্রিয়া প্রতিরোধ করতে সক্ষম। আরেক ধরণের ফুড গ্রেড প্লাস্টিক আছে যার নামের সাথে আমরা অধিক পরিচিত, তা হল পেট (পিইটি), পলি ইথিলিন টেরিফেলেট, সাধারন পানীয় যে বোতলে থাকে। এই পেট প্লাস্টিক হল বহুল ব্যবহৃত প্লাস্টিক যা খাদ্য সংরক্ষন এবং পরিবেশনে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
কিন্তু, আমারা না বুঝেই দিনের পর দিন এই সব প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করে থাকি। অনেকে তো বাচ্চার দুধ ভর্তি প্লাস্টিকের ফিডিং বোতলটাই গরম করে বসেন। প্লাস্টিক বোতলের এমন যথেচ্ছ ব্যবহার আদপেও কি স্বাস্থ্যকর? এ বিষয়ে বাছ-বিচার আমরা করি না। তাই প্লাস্টিক বোতলের তলায় থাকা ত্রিকোণ চিহ্নের মানেটা বুঝে নিলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেতে পারে নিমেষে।
Plastic Bottle Symbols
ত্রিকোণ চিহ্ন— এটা আসলে প্লাস্টিক বোতলের চারিত্রিক ইনডেক্স। এই চিহ্নটা থাকলে বোঝা যায় বোতলটি বিধিসম্মতভাবে তৈরি। কিন্তু, বোতলটা ব্যবহারের কতটা নির্ভরযোগ্য বা কী ধরনের জিনিস তাতে রাখা যাবে, তা ত্রিকোণ চিহ্নের মধ্যে থাকা সংখ্যা দ্বারা বোঝা যায়।
১. ত্রিকোণের মাঝে ১ সংখ্যা থাকলে— এর মানে বোতলটি একবারই মাত্র ব্যবহার করা যাবে এবং বোতলটিতে পলিথিলিন টেরেপথ্যালেট প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়েছে। এই ধরনের বোতল বহুব্যবহারে স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক।পানির বোতলে এ ধরণের প্লাষ্টিক ব্যবহার করা হয়।
২. ত্রিকোণের মধ্যে ২ সংখ্যা থাকলে— এই ধরনের প্লাস্টিক বোতলে ঘন পলিথিন ব্যবহার করা হয়েছে। মূলত শ্যাম্পু বা ডিটারজেন্ট রাখার ক্ষেত্রে এই ধরনের বোতল ব্যবহার হয়।
এটি HDPE (হাই ডেনসিটি পলিইথিলিন) :
তাপমাত্রা সহনশীলতা সীমা ২৩০ ডিগ্রী ফারেনহাইট
৩. ত্রিকোণের মধ্যে ৩ সংখ্যা থাকলে— এই ধরনের বোতল বেশি ব্যবহার করা উচিত নয়। কারণ, এই বোতল তৈরি হয় ‘পোলিভিনিল ক্লোরাইড’ বা ‘পিভিসি’ থেকে। এতে ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ‘পিনাট বাটার’ রাখতে এই বোতল ব্যবহার করা হয়।
৪. ত্রিকোণের মধ্যে ৪ সংখ্যা থাকলে— এই ধরনের প্লাস্টিক বহু ব্যবহারের উপযোগী। বিশেষ করে, প্লাস্টিকের প্যাকেটে এই চিহ্ন প্রচুর দেখা যায়। খুব দামি বোতলে এই চিহ্ন থাকে।
ইহা LDPE (লো ডেনসিটি পলিইথিলিন)
তাপমাত্রা সহনশীলতা সীমা ১৭৬ ডিগ্রী ফারেনহাইট।
৫. ত্রিকোণের মধ্যে ৫ সংখ্যা থাকলে— এই ধরনের প্লাস্টিক একদম নিরাপদ এবং ব্যবহারের যোগ্য। আইক্রিম কাপ বা সিরাপের বোতল অথবা খাবারের কন্টেনারে এই ধরনের চিহ্ন দেখা যায়।
এটি Polyporpelene (পলি প্রোপেলিন)
তাপমাত্রা সহনশীলতা সীমা ২৭৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট।
৬. ত্রিকোণের মধ্যে ৬ অথবা ৭ সংখ্যা থাকলে— প্লাস্টিকের রেড কার্ড বলা হয় একে। এই ধরনের প্লাস্টিক মারাত্মক রকমের ক্ষতিকারক। কারণ এই ধরনের প্লাস্টিক তৈরি হয় পলিস্টিরিন এবং পলিকার্বনেট বিসপেনল-এ। এটা মানুষের মধ্যে হরমোন সমস্যা তৈরি করে। ক্রমাগত এই ধরনের প্লাস্টিকের ব্যবহার ক্যানসারের প্রবণতা বাড়ায়।
কিভাবে জানবেন প্লাস্টিকটি ফুড গ্রেড কি না?
সত্যিকার অর্থে আজকের দিনে প্লাস্টিক পাত্রকে উপেক্ষা করা এতো সহজ নয়। আর তাই খাদ্য কৌটা বা পাত্রের ফুড গ্রেড নিশ্চিত হওয়া খুবই জরুরী। আসুন দেখি কীভাবে নিশ্চিত হবেন পাত্রটি ফুড গ্রেড কি নাঃ
সবচেয়ে সহজ উপায় হল পণ্যের রিসাইক্লিং নাম্বার দেখা। এই নাম্বার ১ থেকে ৭ পর্যন্ত হয়ে থাকে। সবচেয়ে ভালো প্লাস্টিক পাত্র যা খাদ্যের জন্য উপযুক্ত তা হল HDPE, যার রিসাইক্লিং নাম্বার হল ২। এছাড়া রয়েছে PETE, LDPE এবং PP এদের রিসাইক্লিং নাম্বার যথাক্রমে ১, ৪ এবং ৫।
পণ্যের গায়ে কিছু চিহ্ন থাকে, যেমনঃ “কাঁটা-চামচ এবং কাপ” যা দ্বারা বুঝায় পণ্যটি খাদ্য সংরক্ষণের উপযুক্ত; বিকিরণ চিহ্নযুক্ত ঢেউ যা বুঝায় পণ্যটি মাইক্রোওয়েভে নিরাপদ, এছাড়া রয়েছে ফ্রিজার সেইফ, ডিশওয়াশার সেইফ ইত্যাদি চিহ্ন। এইসব চিহ্ন অনেকটাই পণ্যের ফুড গ্রেড নিশ্চয়তা প্রদান করে। কিন্তু একটা কথা, যদি এগুলো যথাযথ নিয়ম মেনে ব্যবহৃত হয়। আমাদের দেশে যে কেউ ইচ্ছা করলেই যে কোন চিহ্ন ব্যবহার করতে পারে, ফলে? সাধু সাবধান।
পণ্যের গায়ে যদি সিল করা সটীকার বা লেবেল থাকে, তবে তা চেক করুন। কারণ, কৌটা যদি ফুড গ্রেড হয়ে থাকে তাহলে লেবেলে এসব চিহ্ন দেয়া থাকবে অথবা লিখিত আকারে উল্লেখ করা থাকবে।
কোন পাত্রে খাবার সংরক্ষণের পূর্বে যাচাই করে নিন এটা খাবার বা পানীয় সংরক্ষণের জন্য প্রস্তুত করা কি না? যদি নিশ্চিত না হন, তবে তা পরিহার করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
সকল ধরণের খাদ্যর একটি নিজস্ব ধরন আছে, সেই জন্য ভিন্ন ভিন্ন খাবারের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ধরনের পাত্র প্রয়োজন। যেমন, উচ্চ অম্লজাতীয় পণ্যগুলো প্লাস্টিক পাত্রে না রাখাই ভালো, কারণ এখানে রাসায়নিক বিক্রিয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। যেমনঃ টমেটো, লেবুর রস ইত্যাদি।
জেনে রাখুন রিসাইক্লিং নাম্বার ১ হল একবার ব্যবহারের জন্য তৈরি প্লাস্টিক পণ্য। রিসাইক্লিং নাম্বার ২, ৪, ৫ হল ফুড গ্রেড নাম্বার। আর ৩, ৬, ৭ মোটেও খাদ্যের জন্য উপযুক্ত প্লাস্টিক নয়।
দীর্ঘ সময় ধরে একই প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার না করা ভাল। প্রতিটি প্লাস্টিক পণ্যের একটি নির্দিষ্ট ব্যবহার মেয়াদ থাকে, এরপর তা ব্যবহার না করাই ভালো। এতে করে প্লাস্টিক কেমিক্যাল রিএকশন এড়ানো সম্ভব।
নিয়মিত প্লাস্টিকের কৌটো ভালোভাবে পরিস্কার করুন এবং ধোয়া শেষে ভালোভাবে বাতাসে শুকিয়ে নিন।
No comments:
Post a Comment