১.দোয়েল
লালমাথা কুচকুচি বাংলাদেশের দুর্লভ পাখি। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।
সমগ্র পৃথিবীতে আনুমানিক ১০ হাজারেরও কম পূর্ণবয়স্ক লালমাথা কুচকুচি রয়েছে।
বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, নেপাল, মায়ানমার, মালয়েশিয়া, লাওস, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও চীনের গহীন চিরসবুজ বনাঞ্চলে লালমাথা কুচকুচির আবাস। এর বঙ্গীয় উপভাষিক নাম কুচকুচিয়া বা কুচকুইচ্যা থেকে ধারণা করা হয় যে বাংলাদেশে একসময় এরা সুলভ ও বেশ সুপরিচিত ছিল। তার কারণ হচ্ছে, যে পাখি সচরাচর জনসাধারণের চোখে পড়ে না, সেই পাখির সাধারণত কোন বাংলা নাম পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয় যে কাঠুরিয়ারা এককালে প্রায়ই পাখিটি দেখতে পেতেন।কিন্তু বাংলাদেশের বনভূমির ব্যাপক ধ্বংসের ফলে পাখিটি বর্তমানে দুর্লভ ও বিপন্ন বলে বিবেচিত। সেদেশে কেবল লাউয়াছড়া ও কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে পাখিটি কদাচিৎ দেখা যায়।
পাখিদের জগতে কেবল ছোট ছোট পাখিরাই রঙচঙে ও উজ্জ্বলতার দিক থেকে প্রথম। লালমাথা কুচকুচি সেদিক থেকে ব্যতিক্রম। এর আকার প্রায় পাতিকাকের সমান হলেও উজ্জ্বলতার দিক থেকে এটি অন্যসব রঙিন ছোট পাখিদেরও হার মানায়। এদের দৈর্ঘ্য ৩৫ সেন্টিমিটার, ডানা ১৪.৫ সেন্টিমিটার, ঠোঁট ২.২ সেন্টিমিটার, পা ১.৯ সেন্টিমিটার, লেজ ১৯.২ সেন্টিমিটার এবং ওজন ৭৫ গ্রাম। পুরুষ কুচকুচির চেহারা স্ত্রী কুচকুচির থেকে কিছুটা আলাদা। পুরুষ কুচকুচির মাথা, ঘাড়, গলা ও বুক সিঁদুরে লাল। পেটের দিকের বাকি অংশ উজ্জ্বল গোলাপি। বুকের লাল ও গোলাপির মাঝখানে একটি সাদা অর্ধবলয় থাকে। লেজ ক্রমান্বয়ে ছোট থেকে বড় পালকে গড়া, অর্থাৎ থরে থরে সাজানো। পিঠ থেকে লেজ হালকা দারুচিনি বা মরচে-বাদামি রঙের। ডানার ঢাকনি-পালক খুবই মিহি সাদা ও ধূসর রেখা খচিত। ডানা মূলত কালো এবং পালকের মাঝবরাবর কিছুটা অংশ সাদাটে। লম্বা লেজের কিনারা কালো ও ডগা কালো বলয়যুক্ত। কিন্তু বাইরের দিকের প্রতিটি পালকের ডগা সাদা যার ফলে লেজের কিনারা ঢেউখেলানো মনে হয়। চোখের তারা সিঁদুরে-লাল, এর চারপাশের চামড়া নীলাভ-বেগুনি। চোখের গোলকের ত্বক বেগুনি-নীল। ঠোঁটের কোণা, পা ও পায়ের পাতা বেগুনি। ঠোঁটের উপরের পাটি বেগুনি-নীল ও নিচের পাটি কালো বর্ণের। স্ত্রী কুচকুচির সারা শরীর দারুচিনি রঙের। আর এমনিতে শরীরের অন্যান্য অংশের গঠন ও রঙ একরকম। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির বুক, বগল ও তলপেট পীতাভ-সাদা।
লালমাথা কুচকুচি শান্ত ও লাজুক পাখি। ঘন প্রশস্ত পাতার চিরসবুজ বন ও মিশ্র বাঁশবনে বিচরণ করে। জন মানুষহীন পাহাড়ি বনভূমিতেই এরা বাস করে; তবে দুই হাজার মিটারের বেশি উঁচু পর্বতে থাকে না এরা। বনের ৪-৬ মিটার উঁচু আলোআঁধারি ভরা ডালে নীরবে অনেকক্ষণ ধরে বসে থাকে। বনের ঘন ছাউনির নিচে উড়ে উড়ে এরা উড়ন্ত প্রজাপতি ও মথ শিকার করে এবং শুঁয়োপোকা ধরার জন্য পাতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পোকামাকড়ের অভাব হলে মাটিতে নেমে বুনো রসালো ফল ও বাঁশের কচি পাতা খায়। এ কারণেই এর দ্বিপদ নাম "ফলচোর"।গাছের আবডালে বসে এরা নম্র-মধুর সুরে কিউ...কিউ... ডাকে। মাঝে মধ্যে গান গায়: টিয়াউপ্......টিয়াউপ্।[২] গলা সুরেলা হলেও এরা আসলে গায়ক পাখি নয়। এর কারণ লালমাথা কুচকুচির ভয়েস বক্স থাকে না। মজার ব্যাপার হল, কোকিলেরও ভয়েস বক্স বা সুর বাক্স নেই। সে কারণে পক্ষীবিজ্ঞানের ভাষায় এরা গায়ক পাখি নয়। পক্ষীবিজ্ঞানের ভাষায় কাক আসলে গায়ক পাখি, কারণ এর ভয়েস বক্স রয়েছে।
এপ্রিল থেকে জুলাই এদের প্রজননকাল। এ সময় ঘন বনে বৃক্ষের প্রাকৃতিক কোটরে কিংবা কাঠঠোকরার শূণ্য গর্তে বাসা করে। বাসায় ৩-৪টি ডিম পাড়ে। ডিমগুলো পীতাভ এবং ডিমের মাপ ২.৮ × ২.৪ সেন্টিমিটার।
৫.নীলপরী
নীলপরীদের বাস বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে। এর ইংরেজি নাম Asian
fairy-bluebird বৈজ্ঞানিক নাম Irena puella. এরা Irenidae গোত্রের
অন্তর্গত। নীলপরী
Passeriformes বর্গের পাখি অর্থাৎ এরা গায়ক পাখি। এদের স্বভাবঃ মিশ্র চিরসবুজ বনে এরা বেশী থাকে। ফুলে ফলে ভরা গাছে এরা বিচরণ করে বোড়ায়। ফুলের রেনু, পাকা ফল এরা খুব বেশী পছন্দ করে। বাংলাদেশের মিশ্র চিরসবুজ বন এলাকা সিলেট ও চট্রগ্রামে এদের বসবাস। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, চীন, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশীয়া, মলোয়েশীয়ায় এদের দেখতে পাওয়া যায়। আপূর্ব সুন্দর এই পাখিটি বন ধ্বংসের সাথে সাথে বাংলাদেশ থেকে ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে একদিন হয়ত আর এদের দেখা যাবে না। এদের সংরক্ষনে বাংলাদেশ বন বিভাগের সাথে আমাদের সবারই সচেতনতার প্রয়োজন।
নীলপরীর পুরো শরীরটা নীল পালকে আবৃত নয়। ঘাড়ের নিচ থেকে পিঠ ধরে লেজ পর্যন্ত নীলচে বর্ণের। ঠোঁট ও পা তদ্রূপ। চোখ ফিকে লাল। লম্বায় আট থেকে দশ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়। পুরো শরীরটা বেশ তাগড়া মনে হয়। ছেলে-মেয়ে দেখতে একই রকম। সূর্যের আলো নীলপরী পাখির পিঠে পড়লে নীলাভ দ্যুতি ঠিকরে বের হয়। তখন যে কেউ দেখলে মুগ্ধ হতে বাধ্য। নীলপরী মোটামুটি সামাজিক পাখি। গাছে গাছেই এদের বিচরণ। বুনো ফল, ফুলের মধু এদের প্রিয়। মাটিতে খুব একটা নামে না এরা। শুধু জলপানের তাগিদ অনুভব করলে তবে নিচে নেমে আসে। একসঙ্গে তখন আরো একটি কাজ সেরে নেয়। জলপান শেষে গোসলাদিও সেরে নেয় ওরা। নীলপরীদের প্রজনন মৌসুম হচ্ছে মার্চ থেকে এপ্রিল। এ সময় এরা তুলনামূলক ছায়াযুক্ত জায়গায় বাসা বাঁধে। সরু কাঠি, গাছের শুকনো লতাপাতা এদের বাসা তৈরির উপকরণ। বেশ সুন্দর বাসা বাঁধতে পারে এরা। জানুয়ারী থেকে জুনের প্রজনন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। প্রতিবার ২-৩টা ডিম পাড়ে এবং ডিমগুলি জলপাই রংয়ের এবং বাদামী ছাপযুক্ত খুব সুন্দর। মেয়ে পাখি একা একা ডিমে তা দেয়। বাসা তৈরি শেষে দুই দিন বিরতি দিয়ে দুটি মাত্র ডিম পাড়ে। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৮ থেকে ২০ দিন। বাচ্চারা বড় না হওয়া পর্যন্ত মা-বাবার সঙ্গে থাকে। ৯ থেকে ১১ ইঞ্চি লম্বা এই পাখিটি সবসময় গাছের মগডালে এবং ঘন জঙ্গলে থাকে। অধিকাংশ পাখির মত এই পাখিরও পুরুষ নারীতে ভিন্নতা আছে। পুরুষ নীলপরী পাখিটা উজ্জল বেগুনি মিশ্রিত নীল রংয়ের এবং চোখের নীচে ও ডানায় কালো রঙে সজ্জিত। মেয়ে নীলপরী একটু মলিন নীল সবুজ এবং বাদামী কালো। স্ত্রী নীলপরী দেখতে ফ্যাকাশে হয়ে থাকে। পুরুষ নারী দুই পাখিটারই চোখ লাল।
৬.পাখির নাম সোনাবউ
পরিচ্ছন্ন গড়নের অতি সুদর্শন পাখি 'সোনাবউ'।
এদের দেথা যায় রায়পুর উপজেলার পূর্ব চরপাতা ও শায়েস্তানগর গ্রামে। এদের জ্ঞাতিভাই হচ্ছে কালোমাথা বেনেবউ বা ইষ্টিকুটুম পাখি। অনেকে এদের দেখলেও সহজে চিনতে পারে না। কালোমাথা বেনেবউ বলে ভুল করে বসেন। ওরা দেশের আনাচেকানাচে যথেষ্ট নজরে পড়লেও সোনাবউ বা সোনালি বেনে বউদের ক্ষেত্রে তা বিরল দর্শন। দেশে খুব বেশি দেখার নজির নেই। বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে রাজশাহী অঞ্চলে প্রথম দেখার নমুনা রেকর্ড করা হয়। মূলত গ্রীষ্মকালে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে বিচরণ করে এরা। শীতে এশিয়ার পশ্চিমাঞ্চল ও আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে কাটিয়ে দেয়। আমাদের দেশে পরিযায়ী হয়ে আসে হিমালয় অঞ্চল থেকে। উত্তরাঞ্চলসহ দেশের অল্প কিছু স্থানে নজরে পড়ে তখন। স্বভাবে লাজুক ও শান্ত। থাকে বেশির ভাগই জোড়ায় জোড়ায়। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি আড়ালে আবডালে গিয়ে প্রেয়সীকে মুগ্ধ করতে গান বাঁধে। মিষ্টিকণ্ঠে নিচু স্বরে গান গায় 'পিউলোলো... উইলো...'। শুনতে খুবই চমৎকার সেই সুর। খিদে পেলে ওদের বাচ্চারাও মিষ্টি সুরে কাঁদে। সেই সুর বড়ই করুণ লাগে। প্রজাতির বাংলা নাম : 'সোনাবউ' বা 'সোনালি বেনেবউ', ইংরেজি নাম : 'ইউরেশিয়ান গোল্ডেন ওরিওল', বৈজ্ঞানিক নাম : 'ওরিওলাস ওরিওলাস'।
এরা 'হলুদিয়া পাখি' নামেও পরিচিত। দেশের পাখিবিশারদদের কেউ কেউ 'ইউরেশীয় সোনাবউ' নামকরণ করেছেন এদের। এরা লম্বায় ২৫ সেন্টিমিটার। পুরুষ পাখির দেহের অধিকাংশ পালকই উজ্জ্বল হলুদ। কেবল ডানা ও লেজের উপরি ভাগের পালক কালো। কালো ডানায় রয়েছে হলুদ পট্টি। ঠোঁটের গোড়া থেকে শুরু করে চোখের ওপর দিয়ে গেছে কালো টান। ঠোঁট সোজা, গোলাপি-লাল। স্ত্রী পাখির বর্ণ একটু ভিন্ন। দেহের ওপরের দিকের পালক সবুজাভ হলদে। পেটের দিকে রয়েছে ফিকে হলুদ-বাদামির প্রচ্ছন্ন খাড়া রেখা। ঠোঁট সোজা, টকটকে লাল। পায়ের রঙ সিসে। অপ্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে পিঠের দিক জলপাই-হলুদ। গলা ও বুক সাদাটে। ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে ফিকে হলুদের ওপর কালো খাড়া রেখা। প্রধান খাবার পোকামাকড়, ফুলের মধু ও ছোট ফল। প্রজনন সময় মার্চ থেকে মধ্য জুন পর্যন্ত। গাছের উঁচু ডালে খড়কুটা দিয়ে দোলনা আকৃতির বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে দু-তিনটি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩ থেকে ১৫ দিন।
৭.মাছরাঙা
মাছরাঙা Coraciiformes বর্গের
অন্তর্গত একদল অত্যন্ত উজ্জ্বল রঙের ছোট বা মাঝারি আকৃতির পাখি। অ্যান্টার্কটিকা বাদে প্রায় সারা পৃথিবীতেই মাছরাঙা দেখা যায়। পুরাতন বিশ্ব আর অস্ট্রালেশিয়াতে এদের বিস্তৃতি সবচেয়ে বেশি। Alcedinidae (অ্যালসিডিনিডি) গোত্র এবং কখনো কখনো Alcedines (অ্যালসিডিনিস) উপবর্গের সকল প্রজাতিই মাছরাঙা নামে পরিচিত। এ উপবর্গের তিনটি গোত্র রয়েছে। গোত্রগুলো হল Alcedinidae (গাঙ মাছরাঙা)Halcyonidae (গেছো মাছরাঙা) ও Cerylidae (পান মাছরাঙা)। সারা পৃথিবীতে প্রায় ৯০ প্রজাতির মাছরাঙা দেখা যায়।
এদের প্রায় সবারই দেহের তুলনায় মাথা বড়, লম্বা, ধারালো ও চোখা চঞ্চু, খাটো পা ও খাটো লেজ রয়েছে। বেশিরভাগ মাছরাঙার দেহ উজ্জ্বল রঙের আর স্ত্রী-পুরুষে সামান্য ভিন্নতা দেখা যায়। অধিকাংশ মাছরাঙা বিষুবীয় অঞ্চলে বসবাস করে এবং এদের বড় একটা অংশকে কেবলমাত্র বনে দেখা যায়। এরা অনেক ধরনের প্রাণী শিকার করে, তবে তার বড় একটি অংশ জুড়ে রয়েছে মাছ। এরা সাধারণত ডালে থেকে ডাইভ দিয়ে পানির মধ্যে থেকে মাছ শিকার করে। অন্যান্য শিকারের মধ্যে রয়েছে পোকামাকড়, ব্যাঙ, সরীসৃপ, পাখি এমনকি ছোট আকারের স্তন্যপায়ী। বর্গের অন্যসব সদস্যদের মত মাছরাঙারাও গর্তে বাসা করে। সাধারণত জলাশয়ের পাশে খাড়া পাড়ের গর্তে এরা বাসা বানায়। কয়েক প্রজাতির দ্বীপবাসী মাছরাঙা বৈশ্বিকভাবে বিপদগ্রস্ত বলে বিবেচিত।
৮.জালালী কবুতর
জালালী কবুতর গত ৭০০ বছর ধরে বাংলা-ভারতীয় অঞ্চলের মানুষ এবং এ অঞ্চলে আসা পর্যটকদের নিকট এক ঐতিহ্যবাহী এবং পবিত্র কবুতরের নাম। বাংলাদেশের প্রায় ২০ প্রজাতির কবুতরের মধ্যে খ্যাতি এবং পরিচিতির দিক থেকে এর অবস্থান শীর্ষে। সম্ভবতঃ এটিই পৃথিবীর একমাত্র কবুতর যার সাথে একটি সুন্দর ইতিহাস জড়িয়ে আছে। আসুন জেনে নিই অলৌকিকতার মহিমায় ভাস্বর সেই ইতিহাস।
ইয়েমেনের বিখ্যাত সূফী দরবেশ ওলীকুল শিরোমণি কুতুবুল আকতাব হযরত শাহজালাল মুজাররদইয়েমেনী(রঃ) (১১৯৭-১৩৪৭ খ্রিঃ) যখন ইসলাম প্রচার করতে সুদূর ইয়েমেন থেকে ১৩০১ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন ভারতের দিল্লীতে পৌঁছান, তখন দিল্লীর বিখ্যাত ওলী-আল্লাহ হযরত নিযামুদ্দীন আউলিয়া (রঃ) (১২৩৮-১৩২৫ খ্রিঃ) তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তির পরিচয় পেয়ে তাঁকে সাদরে অভ্যর্থনা জানান এবং বিদায়ের সময় হযরত শাহ জালাল (রঃ)-এর হাতে উপহার হিসেবে নীল এবং কালো রংয়ের এক জোড়া কবুতর তুলে দেন। এর ঠিক দুই বছর পর অর্থাৎ ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে শাহ জালাল (রঃ) যখন ৩৬০ জন সফরসঙ্গী নিয়ে শ্রীহট্ট জয় করতে বাংলায় আসেন, তখন কবুতর দুটোকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। আর বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনার মধ্য দিয়ে শ্রীহট্ট জয় করে জয়ের প্রতীকস্বরূপ কবুতর দুটোকে উড়িয়ে দেন।সেই থেকে কবুতরগুলো (এবং এদের পরবর্তী বংশধররা) পরিচিতি পায় ‘জালালী কবুতর’ নামে। তবে সিলেটে আঞ্চলিকভাবে এরা ‘জালালী কইতর’ নামেই পরিচিত। সিলেটে কবুতরকে ‘কইতর’ বলা হয়।
জালালী কবুতরের ইংরেজি নাম রক পিজিয়ন (Rock Pigeon)। বৈজ্ঞানিক নাম কোলাম্বা লিভিয়া (Columba livia)। এর অর্থ নীলভে-ধূসর পায়রা। কেননা, জালালী কবুতর সাধারণত নীলচে-ধূসর বর্ণের হয় যেমনটি ছবিতে আপনারা দেখছেন। এরা গড় আয়ু ৫-১০ বছর। জালালী কবুতরের সংখ্যা কত তা আজও জানা না গেলেও এই কবুতর শুমারির উদ্যোগ শীঘ্রই নেয়া হবে বলে জানিয়েছে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণী অধিকার বিষয়ক সংগঠন প্রাধিকার। বাংলাদেশের বন্য প্রাণী আইনে (১৯৮৪) এরা সংরক্ষিত প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত।
অনেকে অবশ্য এই প্রজাতিটিকে গোলা পায়রা বলে ভুল করেন। তবে পাখি বিশেষজ্ঞদের নিকট গোলা পায়রা অন্য প্রজাতি ও বৈশিষ্ট্যের বলে পরিচিত। আর একই রকম দেখতে লাল রংয়ের পায়রাও জালালী কবুতর হিসেবে গণ্য নয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একই প্রজাতির অনেক কবুতরের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা গেলেও এই কবুতরগুলোর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এদেরকে উড়িয়ে দেয়া হলেও এরা হযরত শাহ জালাল (রঃ)-এর দরগাহ (ইন্তেকালের পূর্বে যেখান থেকে তিনি ইসলাম প্রচার করতেন) ছেড়ে চলে যায় নি। সিলেটের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্স এন্ড অ্যানিম্যাল ব্রিডিং বিভাগের প্রভাষক ডঃ নয়ন ভৌমিকের ছয় মাস ব্যাপী গবেষণায় দেখা গেছে, গত ৭০০ বছর যাবৎ এরা দরগাহ প্রাঙ্গনেই রয়ে গেছে। এরা স্বেচ্ছায় দরগাহ ছেড়ে যত দূরেই উড়ে যাক না কেন আবার সেখানেই ফিরে আসে। তবে সিলেট অঞ্চল ছাড়া দেশের অন্যান্য অঞ্চলে যেসকল জালালী কবুতর পাওয়া যায়, সেগুলো মূলতঃ পরবর্তীতে সিলেট থেকে লোকজন কর্তৃক স্থানান্তরিত হয়েছে। আরও জানা গেছে, এই প্রজাতির কবুতরের আদি নিবাস দিল্লী। পরবর্তীতে পাওয়া যেত কেবল দিল্লী আর সিলেটে। তবে এখন বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে।
এদের আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এরা নিজস্ব প্রজাতির সঙ্গী ছাড়া অন্য আর কোনো কবুতর প্রজাতির সাথে মিলিত হয় না। তারপরও বিশেষ সতর্কতা নেয়া হয়েছে দরগাহ প্রাঙ্গনে, বিশেষভাবে সাইনবোর্ডে লিখিত আছে যেন কেউ অন্য প্রজাতির পায়রা এখানে এনে ছেড়ে না দেয়। আছে স্থানীয় লোকজনের কড়া নজরদারি।
এ প্রসঙ্গে একটি কাহিনী উল্লেখ করা যায়। হযরত শাহ জালাল (রঃ)-এর ভাগ্নে হযরত শাহ পরাণ (রঃ) ছিলেন উপরে উল্লেখিত সেই ৩৬০ আউলিয়ার একজন। হযরত শাহ পরাণ (রঃ) কবুতর খেতে খুবই পছন্দ করতেন। তিনি প্রতিদিন একটি করে কবুতর খেতেন যার মধ্যে জালালী কবুতরও থাকত। তবে খাওয়ার পর তিনি পালকগুলো ফেলে না দিয়ে জমিয়ে রাখতেন। একদিন জালালী কবুতরের সংখ্যা কম দেখে খাদেমেদের জিজ্ঞাসা করলে তারা হযরত শাহ জালাল (রঃ)কে আসল ঘটনা খুলে বলেন। এটা জানার পর হযরত শাহ জালাল (রঃ) কিছুটা রাগান্বিত হলে হযরত শাহ পরাণ (রঃ) মামাকে বললেন, "আমি আপনার কবুতরগুলো ফেরত দিচ্ছি।" এরপর সেই রেখে দেওয়া পালকগুলোকে আকাশে উড়িয়ে বললেন, "যাও ! আল্লাহর হুকুমে শাহজালালের দরবারে পৌঁছে যাও।" সাথে সাথে পালকগুলি জালালী কবুতর হয়ে তার মামার দরবারে এসে হাজির হল। সুবহান আল্লাহ !
শান্তির প্রতীক জালালী পায়রা যেমন স্থান করে নিয়েছে মানুষের হৃদয়ে, তেমনি কবি-গীতিকারদের রচনায়। এ পর্যন্ত জালালী কবুতর নিয়ে রচিত গানের সংখ্যা কম নয়; রচিত হয়েছে পল্লীগীতি, ভাটিয়ালী, ভক্তিমূলক গান। এর মধ্যে কিছু গান কুড়িয়েছে সুনাম, গেঁথে রয়েছে মানুষের মনে। তেমনই কয়েকটি গান হচ্ছেঃ
এক.
হবিগঞ্জের জালালী কইতর সুনামগঞ্জের কুড়া
সুরমা নদীর গাংচিল আমি শূন্যে দিলাম উড়া
শূন্যে দিলাম উড়া রে ভাই যাইতে চান্দের চর
ডানা ভাইঙ্গা পড়লাম আমি কইলকাত্তার উপর,
তোমরা আমায় চিননি… তোমরা আমায় চিননি
তোমরা আমায় চিননি…
ডানা ভাইঙ্গা পড়লাম আমি কইলকাত্তার উপর।
হাওরের পানি নাইরে হেথায় নাইরে তাজা মাছ
বিলের বুকে ডানা মেইলা নাইরে হিজল গাছ
বন্ধু নাইরে তাজা মাছ ।
তবু নিদহারা নগরের পথে রাইতের দুপুরে
মরমিয়া ভাটিয়ালী আমার গালায় ঝরে ।
এই সুরে আছেরে বন্ধু অশত্থ বটের ছায়া
এই সুরে বিছাইয়াদেরে শীতল পাটির মায়া
গো বন্ধু অশত্থ বটের ছায়া ।
এইনা সুরের পালের দোলায় খুশির হাওয়া বয়
এই সুরের দৌলতে আমি জগৎ করলাম জয় ।
হবিগঞ্জের জালালী কইতর সুনামগঞ্জের কুড়া
সুরমা নদীর গাংচিল আমি শূন্যে দিলাম উড়া
শূন্যে দিলাম উড়া রে ভাই যাইতে চান্দের চর
ডানা ভাইঙ্গা পড়লাম আমি কইলকাত্তার উপর,
তোমরা আমায় চিননি… তোমরা আমায় চিননি
তোমরা আমায় চিননি…
ডানা ভাইঙ্গা পড়লাম আমি কইলকাত্তার উপর।
(গীতিকার হেমাঙ্গ বিশ্বাস)
দুই.
"বন্ধুর ও বাড়ির জালালী কবুতর
আমার ও বাড়ি আসে রে।"
তিন.
"ঝাঁকে উড়ে আকাশজুড়ে
দেখতে কি সুন্দর
জালালের জালালী কইতর।"
একসময় জালালী কবুতর দেখা যেত সিলেটের বিভিন্ন বাড়ির ছাদে ও আঙ্গিনায়, বাজারে, চালের আরতে। কারো কারো বাড়ীতে বাসাও বাঁধতো ডিম পাড়ত বাচ্চা হতো। এমনকি সিলেট শহরে অবস্থিত ঐতিহাসিক কিন ব্রিজেরও শোভা বর্ধন করত এই জালালী কবুতর। ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে চলা জালালী কবুতরে ছেঁয়ে যাওয়া সিলেটের আকাশ ছিল এক নান্দনিক দৃশ্য। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর সংখ্যা দিন-দিন কমে যাচ্ছে। এখন আর আগের মত দেখা যায় না। কারণ, অনেকে ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে না খেলেও কিছু মানুষ এগুলো ধরে নিয়ে গিয়ে খেয়ে ফেলছে কিংবা বিক্রি করে, অথবা বিভিন্ন স্থানে পাচার করে দেয়।
শুধুমাত্র হযরত শাহ জালাল (রঃ) এবং শাহ পরাণ (রঃ)-এর পুণ্য স্মৃতি রক্ষার্থেই নয়, বরং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং সিলেট অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বজায় রাখতে জালালী কবুতর সংরক্ষন করা এবং এ সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টি করা এখন সময়ের দাবী।
৯।ময়ূর
Phasianidae গোত্রের বড়, চমৎকার ও আকর্ষণীয় রঙের প্রজাতির পাখি। এ উপমহাদেশের নীল ময়ূর বা Indian Peafowl নামে পরিচিত Pavo cristatus সহজেই মানুষের সাহচর্যে বাস করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এ দেশের স্থানীয় পাখি হলেও এ ময়ূর ইউরোপের সব পার্কেই দেখা যায়। সবুজ ময়ূর, P. muticus দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় অন্যতম বিপন্ন এক পাখি। ১৯৩৬ সালে জে. পি চ্যাপিন মধ্য আফ্রিকার জায়ারের নিরক্ষীয় মৌসুমি বনাঞ্চল থেকে প্রথম কঙ্গোময়ূর (Congo Peafowl) বর্ণনা করেন। ময়ূরজাতীয় সব পাখির নিবাস এশিয়ায় হলেও এ ময়ূর কিভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে আফ্রিকায় বসবাস শুরু করেছে তা এখনও রহস্যময়।ইংরেজিতে পুরুষ ময়ূরকে Peacock এবং স্ত্রী ময়ূরকে Peahen বলা হলেও উভয়েই সাধারণভাবে Peafowl নামে পরিচিত। পুরুষ ময়ূরের মাথায় থাকে একটি মুকুট, মাথার দুপাশ সাদাটে, পালকবিহীন। ময়ূরের পালক অসাধারণ উজ্জ্বল, ধাতব আভাযুক্ত সবুজ ও নীল রঙের। লেজের উপরিভাগের পালকগুলি অতিশয় লম্বা; পেখম মেললে এর দের্ঘ্য হয় এক মিটারের বেশি। তামাটে-সবুজ ও নীল রঙের সংমিশ্রণে সজ্জিত চওড়া পালকে অলঙ্কৃত থাকে রঙিন চোখের মতো বড় বড় ফোটা দাগ। স্ত্রী ও পুরুষের প্রণয় লীলার সময় মেলানো পেখমের আন্দোলন অতি বৈশিষ্ট্যময়।
খাঁচায় বদ্ধ ময়ূর এমনিতেও অনেক সময় পেখম মেলে, সম্ভবত তা মানুষজনকে দেখাবার জন্য। লেজের পালকসহ পুরুষ ময়ূরের দৈর্ঘ্য হতে পারে ২-২.২৫ মিটার, স্ত্রী পাখি লম্বায় হয় প্রায় ৮৬ সেমি। স্ত্রী ময়ূরেরও মাথায় মুকুট থাকে, তবে পেখম মেলার মতো লেজে উজ্জ্বল লম্বা পালক নেই। এদের মাথা ও ঘাড় হালকা বাদামি, দেহের উপরের অংশ বাদামি। ঘাড়ের নিচের অংশ নীল রঙের নয়, উজ্জ্বল সবুজ। পেট সাদা, কিছুটা হলুদ আভাযুক্ত। অপরিণত বয়সের পুরুষ দেখতে অনেকটা পরিণত বয়সের স্ত্রী ময়ূরের মতো, তবে পালক বহুলাংশে লালচে-ধূসর। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ ময়ূর বিশেষ ধরনের কর্কশ সুরে ডাকে। পুরুষ ময়ূর বহুগামী, প্রতিটি পুরুষ চার-পাঁচটি স্ত্রী পাখি একসঙ্গে নিজের অধিকারে রাখতে চায়। সাধারণত জানুয়ারি-এপ্রিল এদের প্রজনন কাল, তবে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরেও এদের প্রজনন ঘটে। স্ত্রী ময়ূর সাধারণত ফোটা দাগবিশিষ্ট ৪-৬টি ডিম পাড়ে। বাচ্চা ফুটতে সময় লাগে ২৬-২৮ দিন। আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর পূর্বেও গাজীপুর এলাকার বনে ময়ূর বাস করতো বলে জানা যায়। আশঙ্কা করা হয় এখন এ দেশ থেকে ময়ূর বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
সাধারণ ময়ূরের আরেক জ্ঞাতি সবুজ ময়ূর, P. muticus বাস করে সিলেট এলাকার বনে। এর আকার India peafowl-এর মতোই। এদের পুরুষ ময়ূর বহুলাংশে সবুজ রঙের; মাথার মুকুট খাঁড়া, পাখার মতো ছড়ানো নয়। স্ত্রী ও পুরুষ দেখতে কমবেশি একই রকম। এদের স্বভাব-প্রকৃতি ও প্রজনন আচরণ P. cristatus-এর প্রায় অনুরূপ।
হিন্দু পুরাণ-শাস্ত্রে ময়ূরকে এক পবিত্র পাখি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৬৩ সালে ময়ূরকে ভারতের জাতীয় পাখি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এক সময় সাজ-সজ্জা ও অলঙ্করণের কাজে প্রচুর পরিমাণ ময়ূরের পালক এ উপমহাদেশ থেকে বিদেশে রপ্তানি করা হতো। রোম এবং পরবর্তীতে মধ্যযুগে ইউরোপের কয়েকটি দেশে মাংসের জন্য ময়ূর প্রতিপালন করা হতো।
১০. দ্য চায়নিজ ফিজন্ট
লম্বা লেজবিশিস্ট রঙিন এ পাখিটির অন্য নাম দ্য চায়নিজ ফিজন্ট। এ জাতের পাখিদের মধ্যে গোল্ডেন ফিজন্ট আলাদা হয়েছে সোনালি রঙ ধারণের কারণে। বাজিগর এই পাখির মূল আবাস চীনের পশ্চিম উপকূলীয় এলাকা হলেও ইংল্যান্ডের কিছু কিছু জায়গায় এদের দেখা যায়। এদের পুরুষ প্রজাতির পাখিগুলোর ডানা ও পালকের মাধ্যমে গাঢ় কমলা রঙ ছড়ানোর এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে- যা দেখে মুগ্ধ হতে হয়। তখন আরও সুন্দর দেখায় এদের কালো হলুদ চোখগুলো। এদের মাথা থেকে ঘাড় বেয়ে পিঠের ওপর যেন নেমে গেছে রঙবেরঙের ঢেউ।
১১.দ্য কুয়েটসল
মধ্য
আমেরিকার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জঙ্গল ও পাহাড়ে এই পাখিরা জুটি বেঁধে বাস করে। এদের খাবার
হচ্ছে পাতা, ফল, টিকটিকি ও অন্যান্য ছোট কীট।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, এই প্রজাতির পাখিরা গুয়েতেমালাসহ কিছু দেশে বিপদাপন্ন অবস্থায় বাস করছে। লাল-নীল-সবুজের অপূর্ব সমারোহ ঘটেছে তার শরীরে।
১২.দ্য হুপো
আফ্রো-এশিয়ার কিছু অঞ্চলে রঙিন ডানার এই পাখিদের সাধারণত দেখা যায়। এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এরা তাদের পালকগুলো মাথার ওপর এমন করে সাজিয়ে রাখতে পারে, যেটিকে মুকুটের মতো মনে হয়।
লাতিন শব্দ ‘ইউপুপা’ থেকে এদের নাম হয়েছে ‘দ্য হুপো’। এদের সূঁচালো ঠোঁটটিও যেন মায়াবী।
১৩.দ্য বার্ডস অব প্যারাডাইস
নিউগিনির
কিছু অঞ্চলের গহীন অরণ্যে এই পাখিদের দেখা যায়। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়া ও মোলাক্কাসের
পূর্ব সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায়ও এদের বসবাস রয়েছে।
সাধারণত এরাও জোড়া ছাড়া বসবাস করে না। মেরুন আর হলুদের মিশ্রণ রয়েছে এদের লম্বাটে পালকে।
১৪.দ্য আটলান্টিক পাফিন
নাম দেখেই বোঝা যায় এরা সমুদ্রতীরবর্তী এলাকার পাখি। সাধারণত ছোট মাছ এবং সমুদ্রের পোকামাকড় খেয়ে বেঁচে থাকে এরা। সাধারণত বংশবৃদ্ধির সময়টাতে অসাধারণ রঙিন হয়ে যায় এদের ঠোঁট। কেউ কেউ এদের নাম দিয়েছেন ‘ক্লাউন অব দ্য ওশান’।
১৫. পেঙ্গুইন
উড়তে না জানলেও আদিকাল থেকেই পেঙ্গুইনরা পখি হিসেবেই স্বীকৃত। আদি পাখি পেঙ্গুইনের আবির্ভাব পাঁচ কোটি বছর আগে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ পেঙ্গুইনদের বসবাস বরফ আচ্ছাদিত অ্যান্টার্কটিকাতে। অ্যান্টার্কটিকাতে পেঙ্গুইনের বেশ কয়েকটি প্রজাতি দেখা যায়। দাঁড়িয়ে থাকা একটি পেঙ্গুইনকে হঠাত্ কোটপরা কোনো ভদ্রলোকের মতো দেখায়। দক্ষিণ মেরুর তীব্র শীতল পানি অথবা ঠাণ্ডা বাতাস থেকে নিজেদের রক্ষার করার জন্য এদের দেহে ছোট ছোট উজ্জ্বল পালকের মতো তাপরোধক এবং তাপ পরিবাহী আবরণ থাকে। তাছাড়াও এদের গায়ের চামড়ার নিচে দুই ইঞ্চির মতো পুরু চর্বির স্তর থাকে। মানুষের মতোই পেঙ্গুইন সামাজিক জীব। এরা একা থাকতে পারে না, দলবদ্ধ হয়ে থাকতে পছন্দ করে। এমনকি পানিতে নামার সময়ও এরা একা না নেমে দলবদ্ধ হয়ে থাকতে পছন্দ করে। স্ত্রী পাখি ডিম পাড়লেও ডিমে তা দেওয়ার দায়িত্ব পুরুষ পাখির।
১৬.দুর্লভ পাখি শামুকখোল
এরা শামুক খেতে খুব ভালবাসে। একটা শামুক পেলে ঠোঁট দিয়ে শামুকের খোল ভাঙে। তারপর সেটা ওপরে তুলে আকাশের দিকে মুখ করে গিলে ফেলে। এজন্য এর নাম শামুকখোল। তবে এরা শুধু শামুকই খায় না। মাছ, কাকড়া, ছোট ছোট প্রাণী, ব্যাঙ ইত্যাদিও খায়।
তথ্য সূত্র :উইকিপিডিয়া,বাংলাপিডিয়া,ব্লগস,দৈনিক যুগান্তর,দৈনিক ইত্তেফাক,ঢাকাটাইমস ও ইন্টারনেট হতে সম্পাদিত
The national bird of Bangladesh |
দোয়েল প্যাসেরিফরম অর্থাৎ চড়াই বর্গের অন্তর্গত একটি পাখি। এর বৈজ্ঞানিক নাম Copsychus saularis। ইংরেজিতে এটি Oriental magpie-robin নামে পরিচিত। উল্লেখ্য যে, এই পাখির বাংলা নামটির সঙ্গে ফরাসী ও ওলন্দাজ নামের মিল আছে। ফরাসী ভাষায় একে বলা হয় Shama dayal এবং ওলন্দাজ ভাষায় একে বলা হয় Dayallijster। এটি বাংলাদেশের জাতীয় পাখি। বাংলাদেশের পল্লী অঞ্চলের সর্বত্রই দোয়েল দেখা যায়।
এছাড়াও বাংলাদেশ ও ভারতের জনবসতির আশেপাশে দেখতে পাওয়া অনেক ছোট পাখীদের মধ্যে দোয়েল অন্যতম। অস্থির এই পাখীরা সর্বদা গাছের ডালে বা মাটিতে লাফিয়ে বেড়ায় খাবারের খোঁজে। নানা রকম সুরে ডাকাডাকির জন্য দোয়েল সুপরিচিত। কীট পতঙ্গ, ছোট ছোট শুঁও পোকা এদের প্রধান খাদ্য। কখনো কখনো সন্ধ্যার আগে আগে এরা খাবারের খোঁজে বের হয়। পুরুষ দোয়েল স্ত্রী দোয়েলকে আকৃষ্ট করার জন্য মিষ্টি সুরে ডাকাডাকি করে।
নাতিশীতোষ্ণ দক্ষিণ এশিয়ায় মূলত: বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, চীনের দক্ষিণাঞ্চল ও ফিলিপাইনে এদের পাওয়া যায়। সাধারণThe national birdতThe national bird কাঠসমৃদ্ধ বন, চাষাবাদকৃত জমির আশেপাশে ও জনবসতিতে মানুষের কাছাকাছি এদের দেখতে পাওয়া যায়।
দোয়েল আকারে ১৫-২০ সেন্টিমিটার বা ৭ - ৮ ইঞ্চি লম্বা। এর লম্বা লেজ আছে যা অধিকাংশ সময় খাড়া করে রাখে। পুরুষ দোয়েলের শরীরের উপরিভাগ ও গলার নিচে কালো রঙের, পেট সাদা। ডানার দুই পাশে সাদা রঙের প্যাচ আছে। স্ত্রী দোয়েলের উপরিভাগ ও গলার নিচে ছাই-রঙা হয়। পেটের অংশ পুরুষ দোয়েলের মত উজ্জ্বল নয়, বরং কিছুটা ফিকে সাদা।
দক্ষিণ এশিয়ায় দোয়েলের প্রজননকাল মার্চ থেকে জুলাই; আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জানুয়ারি থেকে জুলাই। প্রজনন সময় পুরুষ দোয়েলের শরীরের রঙ উজ্জ্বলতর হয়। গাছের ডালে বসে স্ত্রী দোয়েলকে আকৃষ্ট করার জন্য হরেকরকম সুরে ডাকাডাকি করে। ডিম দেয়ার এক সপ্তাহ আগে এরা গাছের কোটরে বা ছাদের কার্ণিশে বাসা বানায়। সাধারণত ৪/৫টি ডিম দেয়। ডিমের রং ফিকে নীলচে-সবুজ, তার উপর বাদামী ছোপ থাকে। স্ত্রী দোয়েল ডিমে তা দেয়; ৮ থেকে ১৪ দিন পরে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। প্রজননকালে পুরুষ দোয়েল আগ্রাসী হয়ে ওঠে। তখন বাসার আশেপাশে অন্য পাখিদের আসতে দেয়না।
২.ব্লু গোল্ড ম্যাকাও
Macau is the world's
most valuable species of endangered
birds
|
বিরল প্রজাতির পাখি ব্লু গোল্ড ম্যাকাও ।পৃথিবীর সবচেয়ে দামি পাখি বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি হচ্ছে ম্যাকাও। এই পাখির দাম বিশ্ববাজারে ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা।
ব্লু অ্যান্ড ইয়েলো ম্যাকাও তোতা জাতীয় পাখি ।এই পাখি জনপ্রিয় এবং মানুষের পোষা পাখি হিসাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।এই পাখি দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন অরণ্যের স্বাদুপানির বনাঞ্চলে বাস করতে দেখা যায়।
১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের মায়ামি-ড্যাড কাউন্টিতে ছোট্ট পরিসরে এদের আবাসস্থল গড়ে উঠেছে।
এ পাখি দৈর্ঘ্যে ক্ষেত্র বিশেষে ৭৬ থেকে ৮৬ সেমি (৩০ থেকে ৩৪ ইঞ্চি) এবং ওজনে ৯০০-১৫০০ গ্রাম হতে পারে। এরফলে পাখিটি তাদের পরিবারের অন্যতম বৃহৎ প্রজাতির পাখি হিসেবে বিবেচিত। নীল রঙের ডানা ও লেজ, ঘন নীল চিবুক, নীচের দিকে সোনালী রঙ এবং মাথার দিকে সবুজাভ রঙে সজ্জ্বিত এ পাখিটির নজরকাড়া সৌন্দর্য্য সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। চঞ্চুগুলো কালো রঙের হয়। আবার চোখের নীচে মুখাকৃতি সাদা রঙের। মুখের নীচে ছোট কালো পালক রয়েছে। ম্যাকাও শক্ত চঞ্চুর অধিকারী যা বাদামজাতীয় শষ্যের শক্ত খোলশ ভেঙ্গে ফেলতে সক্ষম ও খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। এছাড়াও এটি গাছে চড়তে পারে ও বৃক্ষ শাখায় ঝুলে থাকতে পারে।
বুনো অবস্থায় এ ধরনের ম্যাকাও বেশ আক্রমণাত্মক ভঙ্গী প্রদর্শন করে। ছোট বাচ্চা ম্যাকাও বেশ চিত্তাকর্ষক ।
সাধারণতঃ ব্লু অ্যান্ড ইয়েলো ম্যাকাও পাখি তার বিপরীত লিঙ্গীয় সঙ্গীকে নিয়ে সারাজীবন একত্রে থাকে। মৃত গাছে এদের বাসা থাকে। স্ত্রী পাখিটি সচরাচর দুই থেকে তিনটি ডিম পেড়ে থাকে। প্রায় আটাশ দিন স্ত্রী পাখিটি ডিমে তা দেয়। প্রায় ৯৭ দিন পর বাচ্চাগুলো বাসা ত্যাগ করে। পুরুষ বাচ্চাকে শুরু থেকেই রঙের মাধ্যমে নির্ধারণ করা যায়। উজ্জ্বল ও ঘন রঙের মাধ্যমেই পাখির লিঙ্গ নিরূপিত হয়।
৩.মৌটুসী
Bangladesh is one of the smaller birds motusi |
বাংলাদেশের ছোট পাখিগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মোটুসী। এদেশে ১১ ধরনের মৌটুসি পাখি দেখা যায়। আকার আকৃতিতে খুবই ছোট। সাধারনত ফুলের মধু খেBangladesh is one of the smaller birds motusiয়ে থাকে। স্ত্রী পাখির গায়ের রঙ ফ্যাকাসে হয়। মৌটুসি mauṭusi ফুলের মধুপানকারী লম্বা ঠোঁটবিশিষ্ট Bangladesh is one of the smaller
birds motusiছোটো রঙিন পাখিবিশেষ, ইংরেজিতে sunbird বলে পরিচিত । ওজনে ৫ গ্রাম থেকে সর্বোচ্য ৪৫ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে অনেটা হামিংবার্ডের মত। প্রজনের সময় পুরুষ মৌটুসী স্ত্রী মৌটুসীকে আকৃষ্ট করার জন্য বিভিন্ন ধরনের অংগ ভংগীমা করে থাকে । অষ্ট্রেলিয়া, এশিয়া, ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এই পাখির অবাদ বিচরন। মৌটুসীরা সাধারনত ফুলের মধুর পাশাপাশি মাকড়সা কে সাচ্ছন্দে শিকার করে থাকে । তার নিজেদের ঘর যত্ন সহকারে খড়কূটো দিয়ে খুপরীর মত করে তৈরী থাকে । এই পাখি সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে সর্বোচ্য ৪৯০ মিটার পর্যন্ত উপরে উড়তে সক্ষম।
৪.লালমাথা কুচকুচি
The rare birds lalamatha kucakuci of Bangladesh |
লালমাথা কুচকুচি বাংলাদেশের দুর্লভ পাখি। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।
সমগ্র পৃথিবীতে আনুমানিক ১০ হাজারেরও কম পূর্ণবয়স্ক লালমাথা কুচকুচি রয়েছে।
বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, নেপাল, মায়ানমার, মালয়েশিয়া, লাওস, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও চীনের গহীন চিরসবুজ বনাঞ্চলে লালমাথা কুচকুচির আবাস। এর বঙ্গীয় উপভাষিক নাম কুচকুচিয়া বা কুচকুইচ্যা থেকে ধারণা করা হয় যে বাংলাদেশে একসময় এরা সুলভ ও বেশ সুপরিচিত ছিল। তার কারণ হচ্ছে, যে পাখি সচরাচর জনসাধারণের চোখে পড়ে না, সেই পাখির সাধারণত কোন বাংলা নাম পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয় যে কাঠুরিয়ারা এককালে প্রায়ই পাখিটি দেখতে পেতেন।কিন্তু বাংলাদেশের বনভূমির ব্যাপক ধ্বংসের ফলে পাখিটি বর্তমানে দুর্লভ ও বিপন্ন বলে বিবেচিত। সেদেশে কেবল লাউয়াছড়া ও কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে পাখিটি কদাচিৎ দেখা যায়।
পাখিদের জগতে কেবল ছোট ছোট পাখিরাই রঙচঙে ও উজ্জ্বলতার দিক থেকে প্রথম। লালমাথা কুচকুচি সেদিক থেকে ব্যতিক্রম। এর আকার প্রায় পাতিকাকের সমান হলেও উজ্জ্বলতার দিক থেকে এটি অন্যসব রঙিন ছোট পাখিদেরও হার মানায়। এদের দৈর্ঘ্য ৩৫ সেন্টিমিটার, ডানা ১৪.৫ সেন্টিমিটার, ঠোঁট ২.২ সেন্টিমিটার, পা ১.৯ সেন্টিমিটার, লেজ ১৯.২ সেন্টিমিটার এবং ওজন ৭৫ গ্রাম। পুরুষ কুচকুচির চেহারা স্ত্রী কুচকুচির থেকে কিছুটা আলাদা। পুরুষ কুচকুচির মাথা, ঘাড়, গলা ও বুক সিঁদুরে লাল। পেটের দিকের বাকি অংশ উজ্জ্বল গোলাপি। বুকের লাল ও গোলাপির মাঝখানে একটি সাদা অর্ধবলয় থাকে। লেজ ক্রমান্বয়ে ছোট থেকে বড় পালকে গড়া, অর্থাৎ থরে থরে সাজানো। পিঠ থেকে লেজ হালকা দারুচিনি বা মরচে-বাদামি রঙের। ডানার ঢাকনি-পালক খুবই মিহি সাদা ও ধূসর রেখা খচিত। ডানা মূলত কালো এবং পালকের মাঝবরাবর কিছুটা অংশ সাদাটে। লম্বা লেজের কিনারা কালো ও ডগা কালো বলয়যুক্ত। কিন্তু বাইরের দিকের প্রতিটি পালকের ডগা সাদা যার ফলে লেজের কিনারা ঢেউখেলানো মনে হয়। চোখের তারা সিঁদুরে-লাল, এর চারপাশের চামড়া নীলাভ-বেগুনি। চোখের গোলকের ত্বক বেগুনি-নীল। ঠোঁটের কোণা, পা ও পায়ের পাতা বেগুনি। ঠোঁটের উপরের পাটি বেগুনি-নীল ও নিচের পাটি কালো বর্ণের। স্ত্রী কুচকুচির সারা শরীর দারুচিনি রঙের। আর এমনিতে শরীরের অন্যান্য অংশের গঠন ও রঙ একরকম। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির বুক, বগল ও তলপেট পীতাভ-সাদা।
লালমাথা কুচকুচি শান্ত ও লাজুক পাখি। ঘন প্রশস্ত পাতার চিরসবুজ বন ও মিশ্র বাঁশবনে বিচরণ করে। জন মানুষহীন পাহাড়ি বনভূমিতেই এরা বাস করে; তবে দুই হাজার মিটারের বেশি উঁচু পর্বতে থাকে না এরা। বনের ৪-৬ মিটার উঁচু আলোআঁধারি ভরা ডালে নীরবে অনেকক্ষণ ধরে বসে থাকে। বনের ঘন ছাউনির নিচে উড়ে উড়ে এরা উড়ন্ত প্রজাপতি ও মথ শিকার করে এবং শুঁয়োপোকা ধরার জন্য পাতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পোকামাকড়ের অভাব হলে মাটিতে নেমে বুনো রসালো ফল ও বাঁশের কচি পাতা খায়। এ কারণেই এর দ্বিপদ নাম "ফলচোর"।গাছের আবডালে বসে এরা নম্র-মধুর সুরে কিউ...কিউ... ডাকে। মাঝে মধ্যে গান গায়: টিয়াউপ্......টিয়াউপ্।[২] গলা সুরেলা হলেও এরা আসলে গায়ক পাখি নয়। এর কারণ লালমাথা কুচকুচির ভয়েস বক্স থাকে না। মজার ব্যাপার হল, কোকিলেরও ভয়েস বক্স বা সুর বাক্স নেই। সে কারণে পক্ষীবিজ্ঞানের ভাষায় এরা গায়ক পাখি নয়। পক্ষীবিজ্ঞানের ভাষায় কাক আসলে গায়ক পাখি, কারণ এর ভয়েস বক্স রয়েছে।
এপ্রিল থেকে জুলাই এদের প্রজননকাল। এ সময় ঘন বনে বৃক্ষের প্রাকৃতিক কোটরে কিংবা কাঠঠোকরার শূণ্য গর্তে বাসা করে। বাসায় ৩-৪টি ডিম পাড়ে। ডিমগুলো পীতাভ এবং ডিমের মাপ ২.৮ × ২.৪ সেন্টিমিটার।
৫.নীলপরী
The mountainous region in nilaparidera of Bangladesh |
নীলপরীর পুরো শরীরটা নীল পালকে আবৃত নয়। ঘাড়ের নিচ থেকে পিঠ ধরে লেজ পর্যন্ত নীলচে বর্ণের। ঠোঁট ও পা তদ্রূপ। চোখ ফিকে লাল। লম্বায় আট থেকে দশ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়। পুরো শরীরটা বেশ তাগড়া মনে হয়। ছেলে-মেয়ে দেখতে একই রকম। সূর্যের আলো নীলপরী পাখির পিঠে পড়লে নীলাভ দ্যুতি ঠিকরে বের হয়। তখন যে কেউ দেখলে মুগ্ধ হতে বাধ্য। নীলপরী মোটামুটি সামাজিক পাখি। গাছে গাছেই এদের বিচরণ। বুনো ফল, ফুলের মধু এদের প্রিয়। মাটিতে খুব একটা নামে না এরা। শুধু জলপানের তাগিদ অনুভব করলে তবে নিচে নেমে আসে। একসঙ্গে তখন আরো একটি কাজ সেরে নেয়। জলপান শেষে গোসলাদিও সেরে নেয় ওরা। নীলপরীদের প্রজনন মৌসুম হচ্ছে মার্চ থেকে এপ্রিল। এ সময় এরা তুলনামূলক ছায়াযুক্ত জায়গায় বাসা বাঁধে। সরু কাঠি, গাছের শুকনো লতাপাতা এদের বাসা তৈরির উপকরণ। বেশ সুন্দর বাসা বাঁধতে পারে এরা। জানুয়ারী থেকে জুনের প্রজনন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। প্রতিবার ২-৩টা ডিম পাড়ে এবং ডিমগুলি জলপাই রংয়ের এবং বাদামী ছাপযুক্ত খুব সুন্দর। মেয়ে পাখি একা একা ডিমে তা দেয়। বাসা তৈরি শেষে দুই দিন বিরতি দিয়ে দুটি মাত্র ডিম পাড়ে। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৮ থেকে ২০ দিন। বাচ্চারা বড় না হওয়া পর্যন্ত মা-বাবার সঙ্গে থাকে। ৯ থেকে ১১ ইঞ্চি লম্বা এই পাখিটি সবসময় গাছের মগডালে এবং ঘন জঙ্গলে থাকে। অধিকাংশ পাখির মত এই পাখিরও পুরুষ নারীতে ভিন্নতা আছে। পুরুষ নীলপরী পাখিটা উজ্জল বেগুনি মিশ্রিত নীল রংয়ের এবং চোখের নীচে ও ডানায় কালো রঙে সজ্জিত। মেয়ে নীলপরী একটু মলিন নীল সবুজ এবং বাদামী কালো। স্ত্রী নীলপরী দেখতে ফ্যাকাশে হয়ে থাকে। পুরুষ নারী দুই পাখিটারই চোখ লাল।
৬.পাখির নাম সোনাবউ
Clean, marking a very handsome birds 'sonabau' of Bangladesh |
এদের দেথা যায় রায়পুর উপজেলার পূর্ব চরপাতা ও শায়েস্তানগর গ্রামে। এদের জ্ঞাতিভাই হচ্ছে কালোমাথা বেনেবউ বা ইষ্টিকুটুম পাখি। অনেকে এদের দেখলেও সহজে চিনতে পারে না। কালোমাথা বেনেবউ বলে ভুল করে বসেন। ওরা দেশের আনাচেকানাচে যথেষ্ট নজরে পড়লেও সোনাবউ বা সোনালি বেনে বউদের ক্ষেত্রে তা বিরল দর্শন। দেশে খুব বেশি দেখার নজির নেই। বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে রাজশাহী অঞ্চলে প্রথম দেখার নমুনা রেকর্ড করা হয়। মূলত গ্রীষ্মকালে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে বিচরণ করে এরা। শীতে এশিয়ার পশ্চিমাঞ্চল ও আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে কাটিয়ে দেয়। আমাদের দেশে পরিযায়ী হয়ে আসে হিমালয় অঞ্চল থেকে। উত্তরাঞ্চলসহ দেশের অল্প কিছু স্থানে নজরে পড়ে তখন। স্বভাবে লাজুক ও শান্ত। থাকে বেশির ভাগই জোড়ায় জোড়ায়। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি আড়ালে আবডালে গিয়ে প্রেয়সীকে মুগ্ধ করতে গান বাঁধে। মিষ্টিকণ্ঠে নিচু স্বরে গান গায় 'পিউলোলো... উইলো...'। শুনতে খুবই চমৎকার সেই সুর। খিদে পেলে ওদের বাচ্চারাও মিষ্টি সুরে কাঁদে। সেই সুর বড়ই করুণ লাগে। প্রজাতির বাংলা নাম : 'সোনাবউ' বা 'সোনালি বেনেবউ', ইংরেজি নাম : 'ইউরেশিয়ান গোল্ডেন ওরিওল', বৈজ্ঞানিক নাম : 'ওরিওলাস ওরিওলাস'।
এরা 'হলুদিয়া পাখি' নামেও পরিচিত। দেশের পাখিবিশারদদের কেউ কেউ 'ইউরেশীয় সোনাবউ' নামকরণ করেছেন এদের। এরা লম্বায় ২৫ সেন্টিমিটার। পুরুষ পাখির দেহের অধিকাংশ পালকই উজ্জ্বল হলুদ। কেবল ডানা ও লেজের উপরি ভাগের পালক কালো। কালো ডানায় রয়েছে হলুদ পট্টি। ঠোঁটের গোড়া থেকে শুরু করে চোখের ওপর দিয়ে গেছে কালো টান। ঠোঁট সোজা, গোলাপি-লাল। স্ত্রী পাখির বর্ণ একটু ভিন্ন। দেহের ওপরের দিকের পালক সবুজাভ হলদে। পেটের দিকে রয়েছে ফিকে হলুদ-বাদামির প্রচ্ছন্ন খাড়া রেখা। ঠোঁট সোজা, টকটকে লাল। পায়ের রঙ সিসে। অপ্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে পিঠের দিক জলপাই-হলুদ। গলা ও বুক সাদাটে। ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে ফিকে হলুদের ওপর কালো খাড়া রেখা। প্রধান খাবার পোকামাকড়, ফুলের মধু ও ছোট ফল। প্রজনন সময় মার্চ থেকে মধ্য জুন পর্যন্ত। গাছের উঁচু ডালে খড়কুটা দিয়ে দোলনা আকৃতির বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে দু-তিনটি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩ থেকে ১৫ দিন।
৭.মাছরাঙা
Kingfisher can be seen around the world |
এদের প্রায় সবারই দেহের তুলনায় মাথা বড়, লম্বা, ধারালো ও চোখা চঞ্চু, খাটো পা ও খাটো লেজ রয়েছে। বেশিরভাগ মাছরাঙার দেহ উজ্জ্বল রঙের আর স্ত্রী-পুরুষে সামান্য ভিন্নতা দেখা যায়। অধিকাংশ মাছরাঙা বিষুবীয় অঞ্চলে বসবাস করে এবং এদের বড় একটা অংশকে কেবলমাত্র বনে দেখা যায়। এরা অনেক ধরনের প্রাণী শিকার করে, তবে তার বড় একটি অংশ জুড়ে রয়েছে মাছ। এরা সাধারণত ডালে থেকে ডাইভ দিয়ে পানির মধ্যে থেকে মাছ শিকার করে। অন্যান্য শিকারের মধ্যে রয়েছে পোকামাকড়, ব্যাঙ, সরীসৃপ, পাখি এমনকি ছোট আকারের স্তন্যপায়ী। বর্গের অন্যসব সদস্যদের মত মাছরাঙারাও গর্তে বাসা করে। সাধারণত জলাশয়ের পাশে খাড়া পাড়ের গর্তে এরা বাসা বানায়। কয়েক প্রজাতির দ্বীপবাসী মাছরাঙা বৈশ্বিকভাবে বিপদগ্রস্ত বলে বিবেচিত।
৮.জালালী কবুতর
How nice to see the swarms of flies across the sky Jalal Jalali kaitara of Bangladesh
|
জালালী কবুতর গত ৭০০ বছর ধরে বাংলা-ভারতীয় অঞ্চলের মানুষ এবং এ অঞ্চলে আসা পর্যটকদের নিকট এক ঐতিহ্যবাহী এবং পবিত্র কবুতরের নাম। বাংলাদেশের প্রায় ২০ প্রজাতির কবুতরের মধ্যে খ্যাতি এবং পরিচিতির দিক থেকে এর অবস্থান শীর্ষে। সম্ভবতঃ এটিই পৃথিবীর একমাত্র কবুতর যার সাথে একটি সুন্দর ইতিহাস জড়িয়ে আছে। আসুন জেনে নিই অলৌকিকতার মহিমায় ভাস্বর সেই ইতিহাস।
ইয়েমেনের বিখ্যাত সূফী দরবেশ ওলীকুল শিরোমণি কুতুবুল আকতাব হযরত শাহজালাল মুজাররদইয়েমেনী(রঃ) (১১৯৭-১৩৪৭ খ্রিঃ) যখন ইসলাম প্রচার করতে সুদূর ইয়েমেন থেকে ১৩০১ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন ভারতের দিল্লীতে পৌঁছান, তখন দিল্লীর বিখ্যাত ওলী-আল্লাহ হযরত নিযামুদ্দীন আউলিয়া (রঃ) (১২৩৮-১৩২৫ খ্রিঃ) তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তির পরিচয় পেয়ে তাঁকে সাদরে অভ্যর্থনা জানান এবং বিদায়ের সময় হযরত শাহ জালাল (রঃ)-এর হাতে উপহার হিসেবে নীল এবং কালো রংয়ের এক জোড়া কবুতর তুলে দেন। এর ঠিক দুই বছর পর অর্থাৎ ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে শাহ জালাল (রঃ) যখন ৩৬০ জন সফরসঙ্গী নিয়ে শ্রীহট্ট জয় করতে বাংলায় আসেন, তখন কবুতর দুটোকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। আর বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনার মধ্য দিয়ে শ্রীহট্ট জয় করে জয়ের প্রতীকস্বরূপ কবুতর দুটোকে উড়িয়ে দেন।সেই থেকে কবুতরগুলো (এবং এদের পরবর্তী বংশধররা) পরিচিতি পায় ‘জালালী কবুতর’ নামে। তবে সিলেটে আঞ্চলিকভাবে এরা ‘জালালী কইতর’ নামেই পরিচিত। সিলেটে কবুতরকে ‘কইতর’ বলা হয়।
জালালী কবুতরের ইংরেজি নাম রক পিজিয়ন (Rock Pigeon)। বৈজ্ঞানিক নাম কোলাম্বা লিভিয়া (Columba livia)। এর অর্থ নীলভে-ধূসর পায়রা। কেননা, জালালী কবুতর সাধারণত নীলচে-ধূসর বর্ণের হয় যেমনটি ছবিতে আপনারা দেখছেন। এরা গড় আয়ু ৫-১০ বছর। জালালী কবুতরের সংখ্যা কত তা আজও জানা না গেলেও এই কবুতর শুমারির উদ্যোগ শীঘ্রই নেয়া হবে বলে জানিয়েছে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণী অধিকার বিষয়ক সংগঠন প্রাধিকার। বাংলাদেশের বন্য প্রাণী আইনে (১৯৮৪) এরা সংরক্ষিত প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত।
অনেকে অবশ্য এই প্রজাতিটিকে গোলা পায়রা বলে ভুল করেন। তবে পাখি বিশেষজ্ঞদের নিকট গোলা পায়রা অন্য প্রজাতি ও বৈশিষ্ট্যের বলে পরিচিত। আর একই রকম দেখতে লাল রংয়ের পায়রাও জালালী কবুতর হিসেবে গণ্য নয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একই প্রজাতির অনেক কবুতরের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা গেলেও এই কবুতরগুলোর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এদেরকে উড়িয়ে দেয়া হলেও এরা হযরত শাহ জালাল (রঃ)-এর দরগাহ (ইন্তেকালের পূর্বে যেখান থেকে তিনি ইসলাম প্রচার করতেন) ছেড়ে চলে যায় নি। সিলেটের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্স এন্ড অ্যানিম্যাল ব্রিডিং বিভাগের প্রভাষক ডঃ নয়ন ভৌমিকের ছয় মাস ব্যাপী গবেষণায় দেখা গেছে, গত ৭০০ বছর যাবৎ এরা দরগাহ প্রাঙ্গনেই রয়ে গেছে। এরা স্বেচ্ছায় দরগাহ ছেড়ে যত দূরেই উড়ে যাক না কেন আবার সেখানেই ফিরে আসে। তবে সিলেট অঞ্চল ছাড়া দেশের অন্যান্য অঞ্চলে যেসকল জালালী কবুতর পাওয়া যায়, সেগুলো মূলতঃ পরবর্তীতে সিলেট থেকে লোকজন কর্তৃক স্থানান্তরিত হয়েছে। আরও জানা গেছে, এই প্রজাতির কবুতরের আদি নিবাস দিল্লী। পরবর্তীতে পাওয়া যেত কেবল দিল্লী আর সিলেটে। তবে এখন বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে।
এদের আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এরা নিজস্ব প্রজাতির সঙ্গী ছাড়া অন্য আর কোনো কবুতর প্রজাতির সাথে মিলিত হয় না। তারপরও বিশেষ সতর্কতা নেয়া হয়েছে দরগাহ প্রাঙ্গনে, বিশেষভাবে সাইনবোর্ডে লিখিত আছে যেন কেউ অন্য প্রজাতির পায়রা এখানে এনে ছেড়ে না দেয়। আছে স্থানীয় লোকজনের কড়া নজরদারি।
এ প্রসঙ্গে একটি কাহিনী উল্লেখ করা যায়। হযরত শাহ জালাল (রঃ)-এর ভাগ্নে হযরত শাহ পরাণ (রঃ) ছিলেন উপরে উল্লেখিত সেই ৩৬০ আউলিয়ার একজন। হযরত শাহ পরাণ (রঃ) কবুতর খেতে খুবই পছন্দ করতেন। তিনি প্রতিদিন একটি করে কবুতর খেতেন যার মধ্যে জালালী কবুতরও থাকত। তবে খাওয়ার পর তিনি পালকগুলো ফেলে না দিয়ে জমিয়ে রাখতেন। একদিন জালালী কবুতরের সংখ্যা কম দেখে খাদেমেদের জিজ্ঞাসা করলে তারা হযরত শাহ জালাল (রঃ)কে আসল ঘটনা খুলে বলেন। এটা জানার পর হযরত শাহ জালাল (রঃ) কিছুটা রাগান্বিত হলে হযরত শাহ পরাণ (রঃ) মামাকে বললেন, "আমি আপনার কবুতরগুলো ফেরত দিচ্ছি।" এরপর সেই রেখে দেওয়া পালকগুলোকে আকাশে উড়িয়ে বললেন, "যাও ! আল্লাহর হুকুমে শাহজালালের দরবারে পৌঁছে যাও।" সাথে সাথে পালকগুলি জালালী কবুতর হয়ে তার মামার দরবারে এসে হাজির হল। সুবহান আল্লাহ !
শান্তির প্রতীক জালালী পায়রা যেমন স্থান করে নিয়েছে মানুষের হৃদয়ে, তেমনি কবি-গীতিকারদের রচনায়। এ পর্যন্ত জালালী কবুতর নিয়ে রচিত গানের সংখ্যা কম নয়; রচিত হয়েছে পল্লীগীতি, ভাটিয়ালী, ভক্তিমূলক গান। এর মধ্যে কিছু গান কুড়িয়েছে সুনাম, গেঁথে রয়েছে মানুষের মনে। তেমনই কয়েকটি গান হচ্ছেঃ
এক.
হবিগঞ্জের জালালী কইতর সুনামগঞ্জের কুড়া
সুরমা নদীর গাংচিল আমি শূন্যে দিলাম উড়া
শূন্যে দিলাম উড়া রে ভাই যাইতে চান্দের চর
ডানা ভাইঙ্গা পড়লাম আমি কইলকাত্তার উপর,
তোমরা আমায় চিননি… তোমরা আমায় চিননি
তোমরা আমায় চিননি…
ডানা ভাইঙ্গা পড়লাম আমি কইলকাত্তার উপর।
হাওরের পানি নাইরে হেথায় নাইরে তাজা মাছ
বিলের বুকে ডানা মেইলা নাইরে হিজল গাছ
বন্ধু নাইরে তাজা মাছ ।
তবু নিদহারা নগরের পথে রাইতের দুপুরে
মরমিয়া ভাটিয়ালী আমার গালায় ঝরে ।
এই সুরে আছেরে বন্ধু অশত্থ বটের ছায়া
এই সুরে বিছাইয়াদেরে শীতল পাটির মায়া
গো বন্ধু অশত্থ বটের ছায়া ।
এইনা সুরের পালের দোলায় খুশির হাওয়া বয়
এই সুরের দৌলতে আমি জগৎ করলাম জয় ।
হবিগঞ্জের জালালী কইতর সুনামগঞ্জের কুড়া
সুরমা নদীর গাংচিল আমি শূন্যে দিলাম উড়া
শূন্যে দিলাম উড়া রে ভাই যাইতে চান্দের চর
ডানা ভাইঙ্গা পড়লাম আমি কইলকাত্তার উপর,
তোমরা আমায় চিননি… তোমরা আমায় চিননি
তোমরা আমায় চিননি…
ডানা ভাইঙ্গা পড়লাম আমি কইলকাত্তার উপর।
(গীতিকার হেমাঙ্গ বিশ্বাস)
দুই.
"বন্ধুর ও বাড়ির জালালী কবুতর
আমার ও বাড়ি আসে রে।"
তিন.
"ঝাঁকে উড়ে আকাশজুড়ে
দেখতে কি সুন্দর
জালালের জালালী কইতর।"
একসময় জালালী কবুতর দেখা যেত সিলেটের বিভিন্ন বাড়ির ছাদে ও আঙ্গিনায়, বাজারে, চালের আরতে। কারো কারো বাড়ীতে বাসাও বাঁধতো ডিম পাড়ত বাচ্চা হতো। এমনকি সিলেট শহরে অবস্থিত ঐতিহাসিক কিন ব্রিজেরও শোভা বর্ধন করত এই জালালী কবুতর। ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে চলা জালালী কবুতরে ছেঁয়ে যাওয়া সিলেটের আকাশ ছিল এক নান্দনিক দৃশ্য। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর সংখ্যা দিন-দিন কমে যাচ্ছে। এখন আর আগের মত দেখা যায় না। কারণ, অনেকে ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে না খেলেও কিছু মানুষ এগুলো ধরে নিয়ে গিয়ে খেয়ে ফেলছে কিংবা বিক্রি করে, অথবা বিভিন্ন স্থানে পাচার করে দেয়।
শুধুমাত্র হযরত শাহ জালাল (রঃ) এবং শাহ পরাণ (রঃ)-এর পুণ্য স্মৃতি রক্ষার্থেই নয়, বরং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং সিলেট অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বজায় রাখতে জালালী কবুতর সংরক্ষন করা এবং এ সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টি করা এখন সময়ের দাবী।
৯।ময়ূর
Excellent and interesting colors of birds Peafowl |
Phasianidae গোত্রের বড়, চমৎকার ও আকর্ষণীয় রঙের প্রজাতির পাখি। এ উপমহাদেশের নীল ময়ূর বা Indian Peafowl নামে পরিচিত Pavo cristatus সহজেই মানুষের সাহচর্যে বাস করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এ দেশের স্থানীয় পাখি হলেও এ ময়ূর ইউরোপের সব পার্কেই দেখা যায়। সবুজ ময়ূর, P. muticus দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় অন্যতম বিপন্ন এক পাখি। ১৯৩৬ সালে জে. পি চ্যাপিন মধ্য আফ্রিকার জায়ারের নিরক্ষীয় মৌসুমি বনাঞ্চল থেকে প্রথম কঙ্গোময়ূর (Congo Peafowl) বর্ণনা করেন। ময়ূরজাতীয় সব পাখির নিবাস এশিয়ায় হলেও এ ময়ূর কিভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে আফ্রিকায় বসবাস শুরু করেছে তা এখনও রহস্যময়।ইংরেজিতে পুরুষ ময়ূরকে Peacock এবং স্ত্রী ময়ূরকে Peahen বলা হলেও উভয়েই সাধারণভাবে Peafowl নামে পরিচিত। পুরুষ ময়ূরের মাথায় থাকে একটি মুকুট, মাথার দুপাশ সাদাটে, পালকবিহীন। ময়ূরের পালক অসাধারণ উজ্জ্বল, ধাতব আভাযুক্ত সবুজ ও নীল রঙের। লেজের উপরিভাগের পালকগুলি অতিশয় লম্বা; পেখম মেললে এর দের্ঘ্য হয় এক মিটারের বেশি। তামাটে-সবুজ ও নীল রঙের সংমিশ্রণে সজ্জিত চওড়া পালকে অলঙ্কৃত থাকে রঙিন চোখের মতো বড় বড় ফোটা দাগ। স্ত্রী ও পুরুষের প্রণয় লীলার সময় মেলানো পেখমের আন্দোলন অতি বৈশিষ্ট্যময়।
খাঁচায় বদ্ধ ময়ূর এমনিতেও অনেক সময় পেখম মেলে, সম্ভবত তা মানুষজনকে দেখাবার জন্য। লেজের পালকসহ পুরুষ ময়ূরের দৈর্ঘ্য হতে পারে ২-২.২৫ মিটার, স্ত্রী পাখি লম্বায় হয় প্রায় ৮৬ সেমি। স্ত্রী ময়ূরেরও মাথায় মুকুট থাকে, তবে পেখম মেলার মতো লেজে উজ্জ্বল লম্বা পালক নেই। এদের মাথা ও ঘাড় হালকা বাদামি, দেহের উপরের অংশ বাদামি। ঘাড়ের নিচের অংশ নীল রঙের নয়, উজ্জ্বল সবুজ। পেট সাদা, কিছুটা হলুদ আভাযুক্ত। অপরিণত বয়সের পুরুষ দেখতে অনেকটা পরিণত বয়সের স্ত্রী ময়ূরের মতো, তবে পালক বহুলাংশে লালচে-ধূসর। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ ময়ূর বিশেষ ধরনের কর্কশ সুরে ডাকে। পুরুষ ময়ূর বহুগামী, প্রতিটি পুরুষ চার-পাঁচটি স্ত্রী পাখি একসঙ্গে নিজের অধিকারে রাখতে চায়। সাধারণত জানুয়ারি-এপ্রিল এদের প্রজনন কাল, তবে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরেও এদের প্রজনন ঘটে। স্ত্রী ময়ূর সাধারণত ফোটা দাগবিশিষ্ট ৪-৬টি ডিম পাড়ে। বাচ্চা ফুটতে সময় লাগে ২৬-২৮ দিন। আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর পূর্বেও গাজীপুর এলাকার বনে ময়ূর বাস করতো বলে জানা যায়। আশঙ্কা করা হয় এখন এ দেশ থেকে ময়ূর বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
সাধারণ ময়ূরের আরেক জ্ঞাতি সবুজ ময়ূর, P. muticus বাস করে সিলেট এলাকার বনে। এর আকার India peafowl-এর মতোই। এদের পুরুষ ময়ূর বহুলাংশে সবুজ রঙের; মাথার মুকুট খাঁড়া, পাখার মতো ছড়ানো নয়। স্ত্রী ও পুরুষ দেখতে কমবেশি একই রকম। এদের স্বভাব-প্রকৃতি ও প্রজনন আচরণ P. cristatus-এর প্রায় অনুরূপ।
হিন্দু পুরাণ-শাস্ত্রে ময়ূরকে এক পবিত্র পাখি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৬৩ সালে ময়ূরকে ভারতের জাতীয় পাখি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এক সময় সাজ-সজ্জা ও অলঙ্করণের কাজে প্রচুর পরিমাণ ময়ূরের পালক এ উপমহাদেশ থেকে বিদেশে রপ্তানি করা হতো। রোম এবং পরবর্তীতে মধ্যযুগে ইউরোপের কয়েকটি দেশে মাংসের জন্য ময়ূর প্রতিপালন করা হতো।
আরো কিছু বিদেশী পাখির সংক্ষিপ্ত পরিচয়।
১০. দ্য চায়নিজ ফিজন্ট
লম্বা লেজবিশিস্ট রঙিন এ পাখিটির অন্য নাম দ্য চায়নিজ ফিজন্ট। এ জাতের পাখিদের মধ্যে গোল্ডেন ফিজন্ট আলাদা হয়েছে সোনালি রঙ ধারণের কারণে। বাজিগর এই পাখির মূল আবাস চীনের পশ্চিম উপকূলীয় এলাকা হলেও ইংল্যান্ডের কিছু কিছু জায়গায় এদের দেখা যায়। এদের পুরুষ প্রজাতির পাখিগুলোর ডানা ও পালকের মাধ্যমে গাঢ় কমলা রঙ ছড়ানোর এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে- যা দেখে মুগ্ধ হতে হয়। তখন আরও সুন্দর দেখায় এদের কালো হলুদ চোখগুলো। এদের মাথা থেকে ঘাড় বেয়ে পিঠের ওপর যেন নেমে গেছে রঙবেরঙের ঢেউ।
১১.দ্য কুয়েটসল
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, এই প্রজাতির পাখিরা গুয়েতেমালাসহ কিছু দেশে বিপদাপন্ন অবস্থায় বাস করছে। লাল-নীল-সবুজের অপূর্ব সমারোহ ঘটেছে তার শরীরে।
১২.দ্য হুপো
আফ্রো-এশিয়ার কিছু অঞ্চলে রঙিন ডানার এই পাখিদের সাধারণত দেখা যায়। এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এরা তাদের পালকগুলো মাথার ওপর এমন করে সাজিয়ে রাখতে পারে, যেটিকে মুকুটের মতো মনে হয়।
লাতিন শব্দ ‘ইউপুপা’ থেকে এদের নাম হয়েছে ‘দ্য হুপো’। এদের সূঁচালো ঠোঁটটিও যেন মায়াবী।
১৩.দ্য বার্ডস অব প্যারাডাইস
সাধারণত এরাও জোড়া ছাড়া বসবাস করে না। মেরুন আর হলুদের মিশ্রণ রয়েছে এদের লম্বাটে পালকে।
১৪.দ্য আটলান্টিক পাফিন
They are birds of the sea |
১৫. পেঙ্গুইন
The majority of live penguins covered in snow ayantarkatikate |
উড়তে না জানলেও আদিকাল থেকেই পেঙ্গুইনরা পখি হিসেবেই স্বীকৃত। আদি পাখি পেঙ্গুইনের আবির্ভাব পাঁচ কোটি বছর আগে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ পেঙ্গুইনদের বসবাস বরফ আচ্ছাদিত অ্যান্টার্কটিকাতে। অ্যান্টার্কটিকাতে পেঙ্গুইনের বেশ কয়েকটি প্রজাতি দেখা যায়। দাঁড়িয়ে থাকা একটি পেঙ্গুইনকে হঠাত্ কোটপরা কোনো ভদ্রলোকের মতো দেখায়। দক্ষিণ মেরুর তীব্র শীতল পানি অথবা ঠাণ্ডা বাতাস থেকে নিজেদের রক্ষার করার জন্য এদের দেহে ছোট ছোট উজ্জ্বল পালকের মতো তাপরোধক এবং তাপ পরিবাহী আবরণ থাকে। তাছাড়াও এদের গায়ের চামড়ার নিচে দুই ইঞ্চির মতো পুরু চর্বির স্তর থাকে। মানুষের মতোই পেঙ্গুইন সামাজিক জীব। এরা একা থাকতে পারে না, দলবদ্ধ হয়ে থাকতে পছন্দ করে। এমনকি পানিতে নামার সময়ও এরা একা না নেমে দলবদ্ধ হয়ে থাকতে পছন্দ করে। স্ত্রী পাখি ডিম পাড়লেও ডিমে তা দেওয়ার দায়িত্ব পুরুষ পাখির।
১৬.দুর্লভ পাখি শামুকখোল
বাংলাদেশের আবাসিক
দুর্লভ
পাখি। দেখতে
বকের
মতো। তবে
অনেক
বড়। গায়ের
রঙ
ধূসর
সাদা। তবে
বাসা
বাঁধার
সময়
শরীর
একদম
সাদা
হয়ে
যায়। লেজ
ও
পাখার
শেষভাগ
কালো
রঙের। বাংলাদেশের বড়
পাখিদের একটা। ৮১
সেন্টিমিটার লম্বা
হয়। প্রতিটা পাখার
দৈর্ঘ্য চুয়াল্লিশ সেন্টিমিটার। ঝাঁক বেঁধে
চলে। একেক
ঝাঁকে
৪০
থেকে
৬০টি
পাখি
থাকে। জলচর
পাখি। নদী,
হাওড়-বাওড়, মিঠাপানির জলাশয়,
হ্রদ,
ধানক্ষেত ও
উপকূলীয় বনে
এদের
দেখা
যায়। এদের
দেহের
সবচেয়ে
আকর্ষণী অংশ
হলো
ঠোঁট। ইয়া
বড়
আর
ভারী
ঠোঁট। চৌদ্দ
সেন্টিমিটার লম্বা
হয়। দুই
ঠোঁটের মাঝখানে ফাঁক
থাকে।
এরা শামুক খেতে খুব ভালবাসে। একটা শামুক পেলে ঠোঁট দিয়ে শামুকের খোল ভাঙে। তারপর সেটা ওপরে তুলে আকাশের দিকে মুখ করে গিলে ফেলে। এজন্য এর নাম শামুকখোল। তবে এরা শুধু শামুকই খায় না। মাছ, কাকড়া, ছোট ছোট প্রাণী, ব্যাঙ ইত্যাদিও খায়।
এরা যেসব এলাকায় থাকে সেসব এলাকা বিরাট একটা কলোনি গড়ে তোলে। একেকটা বড় গাছে একটা করে ঝাঁক বাস করে। তবে গাছ যদি আরও বড় হয় তবে ঝাঁকও অনেক বড় হয়। বগুড়ার বিহার হাটের দুটি অশ্বত্থ গাছে প্রায় ৪০০ পাখি বাস করে। এরা সারাবছর একই জায়গায় কাটিয়ে দেয়। তবে খাবারের অভাব হলে অন্য জায়গায় চলে যায়। বাসা বাঁধার সময় এরা পানকৌড়ি ও বকের সাথে বিরাট কলোনি গড়ে তেলো। কলোনিতে বাস করার কারণ হলো বাচ্চাদের নিরাপত্তা। চিল, বাজ পাখি, কাক কিংবা মানুষ এদের ছানাদের ক্ষতি করতে এলে ঝাঁকবেধে তেড়ে আসে।
বড় পাখিদের বাসাও বড় হয়। বড় বড় আমগাছ, শিমুলগাছ, বট ও অশ্বত্থ গাছের উঁচু ডালে বাসা বাঁধে। এক একটা গাছে ২০ থেকে ৩০ বাসা দেখা যায়। কোনো কোনো গাছে একশোরও বেশি বাসা থাকে। গাছের শুকনো ডাল, কঞ্চি ও লতাপাতার সমন্বয়ে বাসা তৈরি করে শামুকখোল পাখি। স্ত্রী ও পুরষ পাখি মিলে দশ-বারোদিন ধরে বাসা তৈরি করে। বাসার দৈর্ঘ্য পাঁচফুট পর্যন্ত হয়। জুলাই-আগস্ট মাসে তিন থেকে পাঁচটি ডিম পাড়ে। ডিম মুরগির ডিমের চেয়ে বড়। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দুজন মিলে ডিমে তা দেয়। ২৫ দিন লাগে ডিম ফুটে ছানা বেরুতে। ৩০ থেকে ৩৫ দিন বয়স হলে ছানারা উড়তে শেখে।
তথ্য সূত্র :উইকিপিডিয়া,বাংলাপিডিয়া,ব্লগস,দৈনিক যুগান্তর,দৈনিক ইত্তেফাক,ঢাকাটাইমস ও ইন্টারনেট হতে সম্পাদিত